জীবনে
দেখি নাই যার মুরতি
১
খিদে পেয়েছে একটু একটু, কিছু খেলে হয়, তখন থেকে তো হাঁটছিস।
ক্যাম্পাস
থেকে দিশারী অব্দি হাঁটার আইডিয়াটাই তোর বোগাস যাই বলিস।
কেন
ভাই, তোর ভার্সিটির মাঠেই চারপাক দে না দৈনিক, অত বড়ো
মাঠটা ফাঁকায় পড়ে থাকে, আরে তুই একদিন দৌড়ঝাঁপ হাটাহাটি শুরু
কর, দেখবি হোস্টেলের দু’জন ঠিক জুটে
যাবে, ওই সৈকত আর শিবু।
আর
দরকারটা যেহেতু তোর, ভুঁড়ি যেহেতু নাক স্পর্শ করছে!
আরেএএহ্হঃ! আস্তে...এদিকে!!! উফফফ!
তাঁকাস কোনদিকে!?😑 এখুনি
টোটোচাপা পড়তে যাচ্ছিলি, যদিও সাকুল্যে ডান পায়ের নখে একটা
জোরদার ব্যথা পেতিস, আমি জানি, কিন্তু
খবর বেরুতো বেপরোয়া টোটোর আঘাতে আহত ছাত্র।
কেন
জানিস,
ঐযে দেখছিস লালচুল লালগোঁফ লোকটা, যিনি এই
মুহূর্তে শান্তিপাড়া মোড় চত্বরে দাঁড়িয়ে থাকা মহামানবদিগের মধ্যে রোগাতম, আরে ঐ যে কাঁধে ব্যাগ আর বাইকে হেলান দিয়ে আধদাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে,
উনি জলপাইগুড়ির সাপ্তাহিক সংবাদপত্র ‘জলসন্দেশ’-এ কাজ করেন, সাংবাদিক।
পত্রিকাগোষ্ঠীর
তরফে ওঁকে মাইনে দিয়ে রেখেছে। তা তিনি
কাজটি করতেন না,
কিন্তু সপ্তাহে একটি দীর্ঘকবিতা ছাপার অফারটা পেয়ে উনি ধন্য।
উনি
কবি। মরণ মৃধা তাঁর শুভনাম, তাঁকে জলপাইগুড়িকবিকুলতিলক বলা যায়।
রবিবারের
এক্সট্রা পাতা
‘জলবাসর’ তাঁর কবিতা পাতাভরে ছাপে।
তবে
তুই তাঁর কবিতা পড়িসনি, মানে তোর সে সৌভাগ্য হয়নি।
সে যাইহোক, যেটা বলছিলাম, এই অ্যাকসিডেন্টের খবরটা উনিই করতেন।
বেশ
অতিরং মিশিয়ে। শহরে টোটোর দৌরাত্ম্য, মিউনিসিপ্যালিটির উদাসীনতা থেকে শুরু ক’রে বহিরাগত
ছাত্রদের মিনিমাম নিরাপত্তা দিতে জলশহর অপারগ ইত্যাদি অব্দিও তিনি টানতেন।
এই
শহরের সবকিছুই ওঁর কাছে বেশ টানটান। আগে বাংলাসাহিত্য
টিউশনি পড়াতেন। তবে বেছে বেছে ছাত্রীদেরই শুধু।
একবার
নাকি সেন্ট্রাল গার্লসের একটি অবলা মেয়ে তাঁর টানের আওতায় পড়ে গেছলো, তাই নিয়ে কত কেচ্ছা! তবে অ্যাজ এ রেজাল্ট তাঁর
টিউশনমাস্টারিটা গেলোনা, উনি নাকি এখন দু একজন ছাত্র পড়ান।
তোর এসব জানার কথা নয়।
তুই
তো জলসন্দেশও পড়িস না বর্তমান কাব্যচর্চা নিয়ে খোঁজখবরও রাখিস না।
খালি
শহরের এই গলি ঐ মোড়ে কোথায় কোন সহদেব বসাক দু’টাকা পিস সিঙ্গাড়া দ্যায়,
কোন খন্দকারের মোগলাই না খেলে তোর, ভানু
বন্দোপাধ্যায়ের ভাষায় যাকে বলে ‘জীবনোব্রিথা’।
যখন
প্রেমিক ছিলি তখন সমাজপাড়ার চিকেন পকোড়ার সাথে যে অবিচ্ছেদ্য সখ্যতা অচিরেই স্থাপিত
হয়েছিলো তা প্রেমের দফা রফা হয়ে যাবার পরেও তুই অটুট রেখেছিস! ব্রাভো, সখ্যর প্রতি এরকম ভালোবাসাই কাম্য।
আর
হ্যাঁ,
এখন ভানু বন্দোপাধ্যায়ের ভক্ত হিসেবে তুই নিজেকে দাবি করতে পারিস।
উফঃ
যেভাবে কৌতুকগুলো রিপিট ক’রে ক’রে চালিয়ে
একা একাই হাসিস! না তাতে অবশ্য অমিতাভ বচ্চনের প্রতি আনকন্ডিশনাল
ফলোয়ারশিপের সাথে আপস করতে হয়নি।
অনেক ভাবা হয়ে গেল দ্যাখ, হাঁফাচ্ছিস। খিদে পেয়েছে।
তোর
পকেটে সাতান্ন টাকা আছে। ওইতো স্টেট
ব্যাংকের এটিএমটার সামনে নতুন একটা ঠ্যালাগাড়ি দেখা যাচ্ছে, চ, সামনের বেঞ্চিটা ফাঁকা, উজ্জ্বল।
২
আমার মাথায় সবসময় একটা
আমি বিরাজ করে। বা বলা ভালো রাজ করে।
সে
সর্বদা আমাকে জগতের সাথে রিলেট করে, বাইরের সিগন্যাল গুলো নিয়ে আমাকে বোঝাতে
চায় ‘দ্যাখ ব্যাপারটা হোলো এই, বুঝলি
তো’। কিছু আমি বুঝি আর কিছু সম্পর্কে শুধুই ওয়াকিবহাল
থাকি,
ব্যাস। আর ভাবনাটা
সেই আমির কাজ,
সেটা আরো তীব্র জিনিস, অপ্রতিরোধ্য।
সেটার
কোনো ভেক্টর রাশি স্কেলার রাশি নেই, ডিরেকশন নেই, ক্যালকুলেশন নেই। তবে হ্যাঁ, একটা জিনিস আছে, আমি টের পাই, সাউন্ড। শব্দ।
আমি
আমার ভাবনাগুলো শুনি। দেখিনা, স্পর্শ অনুভব করিনা, স্বাদ পাইনা, গন্ধ পাইনা― শুনি।
ধরা
যাক এখন আমি যে রাস্তায় যান চলাচল কিংবা মানুষজনের বা অন্যান্য যেসব শব্দ শুনছি তা
বাইরে থেকে প্রবেশ করা শব্দ, এগুলি ছাড়াও আমার মাথায় যা ভাবনা চলছে
তার একটা ‘শব্দ’ কিন্তু আমি
‘শুনছি’। ভাবনার লয়
আছে। আমার মাথার ভেতরকার আমিটা (আমি অনেকবার চেষ্টা করেছি বাকি প্রত্যঙ্গ দিয়ে ভেবে দেখার, যেমন হাত দিয়ে ভেবে দেখার, পারিনি।
কী
যে রহস্য এই দেহের। ভাবনা ব্যাপারটাই
যেন মাথাস্থানীয়।) এতক্ষন আমাকে দ্রুতলয়ে ঐ উপরের (প্রথম পর্ব)
জিনিসগুলো ভাবাতে ভাবাতে এতদূর এলো।
দ্রুতলয়ে, কারণ আমি হেঁটেছি জোরে জোরে।
এই
হলো আরেকটা ব্যাপার, শরীর দিয়ে ওর সাথে সংযোগ করা যায়।
বডি
ইজ দ্য অনলি লিংক দ্যাট কানেক্টস্ ‘মি’ উইথ দ্য
'সুপার-মি’।
ক্ষুদ্র
আমির সাথে মহাআমির যোগাযোগ। আর মহাআমি
সব জানে,
মহাসত্য জানে। ওইযে সাংবাদিক
আর কবি ভদ্রোলোকটির কথা যেমন অবলীলায় ব’লে দিলো।
এরকম
হয়।
দোকানটা নতুন এ তল্লাটে, নইলে সপ্তাহে দুদিন এই রাস্তা দিয়েই আমি পড়াতে যাই, কই চোখে তো পড়েনি। দোকান মানে
যেরম হয় আরকি,
একটা ভ্যান, তাতে চপ ঘুগনি চাউমিন মোমো মোগলাই
বিক্রি করছেন একজন। বয়স খুব
সম্ভবত...নাঃ আন্দাজ করতে ইচ্ছে করছে না।
এটা
ভাবতেই টের পেলাম কিছুই তেমন ইচ্ছে করছেনা এই মুহূর্তে।
না
না আমার ফিরতে ইচ্ছে করছে, হোস্টেলে।
কিন্তু
ক্লান্ত লাগছে।
আমি দোকানটার সামনের
সেই আমিকথিত উজ্জ্বল বেঞ্চিটায় বসলাম। আশ্চর্য্য, ক্লান্তিভাবটা চলে যাচ্ছে…
৩
চল ওঠ।
ফিরতে
হবে। হাঁটতে হবে।
গিয়ে
স্নান। পড়তে হবে।
আরো
অনেক
‘হবে’ কে ‘হচ্ছে’
হয়ে ‘হয়ে গেছে’ হতে হবে। তাই তো হয়
জ্যোতি। সবকিছুরই একটা ‘নেই’ ইতিহাস থাকে, তারপর ‘আছে’
ইতিহাস। এবং কোনো
না কোনো ভাবে একদিন না একদিন ফের সেটা ‘নেই’ হয়ে যায়। এই যে তুই, ১৯৯৫ এর জানুয়ারির এক ভোরে ধুপগুড়ির এক গ্রামে আঁতুরঘরে বায়োলজিক্যালি এবং
হিস্টোরিক্যালি জন্ম হলো তোর, নারায়ণ চন্দ্র বিশ্বাসের নাতি,
১৯৯৪ বা তার পূর্বে তো তোর ‘নেই’
পর্বের ইতিহাস। তুই তখন
অংকের ভাষায় মাইনাস জ্যোতির্ময় বিশ্বাস। তারপর থেকে
তোর পজিটিভ ইতিহাস চালু হলো। ‘আছে’-র ইতিহাস।
তেমনি
আরেকটা সময় আসবে যখন আবার আরেকটা ‘নেই’ পর্ব
চালু হবে। দুটো ‘নেই’ এর কী ভীষণ তফাৎ ভেবে দেখেছিস? জীবন একটা মধ্যবর্তী অবস্থান।
তা
সে প্রাণীর জীবন হোক আর জড়পদার্থের।
নিজেকে কখনো দেখেছিস? প্লিজ, আয়নার কথা বলিস না, ছবির কথাও নয়। যে দেখা
শুধু ইনফরমেশন দেয় তা কি মহৎ দেখা? নিজেকে দেখার অর্থ আমাকে দেখা।
মহাআমিকে।
আমাকে
আয়নায় দেখা যায়না।
(লেখা সমাপ্ত হয়না)
[আখ্যানের
শিরোনামটি শ্রী কালাচাঁদ দরবেশের একটি গানের পংক্তি]
(চিত্রঋণ : D'Vatz
“Running Deer”)
কেয়া বাত জ্যোতিদাদা। দারুণ গল্প। লেখা সমাপ্ত হয়না।
ReplyDeleteএর কোনও সমাপ্তি নেই। হবে কি করে এতো গল্প নয় আত্মকথন। ভাল লাগলো জ্যোতির্ময়।
ReplyDeleteপড়তে পড়তে ডুবে গেছিলাম। মনে হচ্ছে আমিই বলছি
ReplyDeletebhaloi lagilo bhai@ avishek ghosh
ReplyDeleteactually your soul" is the real link that connects you with the(super you (jyoti))":)
ReplyDeleteলেখাটি বেশ উপভোগ করলাম। চমৎকার!
ReplyDelete