বাক্‌ ১১১ : দামিনী আজও : প্রদোষ পাল

John Henry Fuseli - The Nightmare  1781



শিল্প এখানে গৌণ। কল্পনা? হয়তো হাস্যকর! রুঢ় করুণ নির্মম বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে এবারকার সিনেমার কাহিনি। ডেনমার্ক সুইডেনের যৌথ উদ্যোগে নির্মিত ‘Lilya 4-ever’, পরিচালক লুকাস মডিশন। হ্যাঁ, এ সিনেমা শিল্পগুণে একেবারেই হয়তো মহিমান্বিত নয়। নেই মাস্টারপিস ফটোগ্রাফি, নেই তেমন উচ্চমানের মিউজিক, যা যা একটা ভালো সিনেমা থেকে আমরা আশা করি। কোনোটাই হয়তো নেই। কিন্তু বাস্তবের আয়নার সামনে দাঁড়ালে কেমন অসহায় মনে হয়বিশেষ করে পুরুষ হিসেবে। নিত্য দিন যে সংবাদ দেখতে দেখতে, পড়তে পড়তে হয়তো কখনো আমাদের ক্লান্তিও আসে। হয়তো গা সওয়া ক্লান্তি! একবিংশ শতাব্দীতে বিশ্বায়নের হাওয়া আমাদের সব ক্লান্তি নিমেষে উড়িয়েও নিয়ে যায়। মাত্র সাড়ে চার বছর মাত্র সাড়ে চার বছরেই কতকিছু ওলোটপালট করে দিল বিশ্বায়ন। মাঝে মাঝে ভাবি, নির্ভয়া’-র জন্য সাড়ে চার বছর আগে দিল্লি তোলপাড় হয়ে গিয়েছিল। নতুন প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা কনকনে ঠান্ডায় স্রেফ খোলা আকাশের নিচে দিনের পর দিন রাত কাটিয়েছে ঐ হতভাগিনীকে ভর সন্ধ্যায় যারা বাসের মধ্যে পৃথিবীর ঘৃণ্যতম বলাৎকার ও পৈশাচিকতায় হত্যা করেছিল তাদের শাস্তির দাবিতে। কত সামান্য চাওয়া, কিন্তু কী অসামান্য প্রতিক্রিয়া, কী অসামান্য আত্মত্যাগ! শুধু তো সামাজিক নয়, পরবর্তী পর্যায়ে প্রচলিত রাজনৈতিক ধ্যান ধারণাও বদলে দিয়েছিল ঐ ঘটনা। বর্তমান সময়ে হলে কী হতো? বাসে ট্রামে, মেট্রো, ট্রেনে এমনকি রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে যেভাবে কানে তার গোঁজা মানুষের দুহাত সদা সচল থাকে, সচল থাকতে হয়, বা থাকতে চায়, তারা নির্ভয়ার জন্য কতটা আত্মত্যাগ করতো? কতটা সময় ব্যয় করতো? হয়তো কোনো মানে নেই, তবুও মাঝে মাঝে এসব প্রশ্ন উঁকি দ্যায়! না, আলোচনাকে অন্যদিকে প্রসারিত করবো না। আসলে লীলার কাহিনি বলতে গিয়ে কেন যেন নির্ভয়াহতভাগিনীর কথা মনে এসে পড়লো!    
        ছবির নির্মাপর্ব ২০০২। ঘটনা ১৯৯২-এ সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর। শয়ে শয়ে কারখানা বন্ধ। লক্ষ লক্ষ মানুষ বেকার। কারখানার কর্মীদের কোয়ার্টার প্রায় শূন্য। কাজের সন্ধানে যে যেখানে পেরেছে পালিয়েছে। গুটিকতক পরিবার, যাদের হয়তো যাবার জায়গা নেই তারাই রয়ে গিয়েছে। যদিও প্রথম দৃশ্যের পর ফ্ল্যাশব্যাকে ঘটনাটি দেখানো হয়েছে। কিন্তু আমি শুরু করছি ফ্ল্যাশব্যাক থেকেই।

     একটি ষোল বছরের মেয়ে, লীলাকে নিজের জিনিসপত্র গোছাতে দেখা গেল।বেল বাজিয়ে লীলার বান্ধবী ঘরে প্রবেশ করতে তাকে লীলা জানাল, যে সে তার মা আর মায়ের বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে আমেরিকায় চলে যাচ্ছে। বান্ধবী বিশ্বাস করলো না। ইউ আর জোকিংহয়তো বান্ধবীও চাইছিল ঐ নরক থেকে বেরতে, তাই তার কাছে ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য লেগেছে। লীলা খুশি খুশি ভাবে জানাল, সামনের শুক্রবারেই সে চলে যাচ্ছে।          
        শুক্রবারের আগের দিন ডিনার টেবিলে লীলার মা জানাল, এখনই তাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে পারছে না। ওখানে গিয়ে স্থায়ী হওয়ার পর নিয়ে যাবে। আপাতত সে তার কাকীমার কাছেই থাকবে। আকাশ ভেঙে পড়ল লীলার মাথায়। যাবার আগের মুহূর্তে মা যখন বিদায় জানাতে এল তখন সে গুম হয়ে বসে। মায়ের সঙ্গে কোনো কথা সে বলেনিকিন্তু গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার শব্দ কানে যেতেই লীলা পাগলের মতো ছুটতে লাগল গাড়ির পেছনে। আমাকে ফেলে যেও না, আমি একা থাকতে পারবো না মাবুকফাটা কান্না শুনে মা গাড়ি থেকে নেমে মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেও কিছু করার ছিলনা। সময় নেইবয়ফ্রেন্ডের তাড়া। মা বেরিয়ে গেল। রাস্তার জলকাদায় আছাড় খাওয়া লীলার কান্নায় চারদিকের বাতাস ভারি হয়ে উঠল 


            
        কত কঠিন নির্মম পরিস্থিতি তার জন্য অপেক্ষা করছে তা কি ওইটুকু মেয়ে অনুভব করতে পেরেছিল? তাই কি বুকফাটা হাহাকারে মাকে বোঝাতে চেয়েছিল...মাগো আমাকে ফেলে যেও না? রাগে দুঃখে মায়ের ছবি কুটিকুটি ছিঁড়ে ফেলেও আবার জোড়া দিয়ে রাখল। তার যেটুকু অবলম্বন ওই মা। মা কথা দিয়েছে পরে তাকে নিয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তব? বাড়িতে ফিরতেই কাকীমা জানাল, এ্যতো বড় বাড়িতে তার থাকা যাবেনা, অন্য বাড়িতে যেতে হবে। প্রতিবাদ করেও লীলার মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় ছিল নাঅত্যন্ত নোংরা ছোটো একটি ঘরে কাকীমা তাকে নিয়ে গেল। যে ঘরে কিছুদিন আগেই এক বৃদ্ধ মারা গিয়েছে। তার ব্যবহৃত নোংরা বিছানা সব আস্তে আস্তে পরিষ্কার করে তাকে বাসযোগ্য করে তুলল সে। প্রতিদিন লেটারবক্স খুলে দ্যাখে, মায়ের চিঠি আর আসে না।     
       একদিন তার স্কুলের বান্ধবী লীলাকে শহরে নিয়ে গেল ট্রেনে চাপিয়ে। দুজনে গিয়ে ঢুকল একটি নাইটক্লাবের পার্টিতে। কিছুক্ষন বাদে তাকে একটি টেবিলে বসতে বলে বান্ধবী একজন মধ্যবয়সী পুরুষের সঙ্গে কোথায় যেন চলে গেল। লীলা ঠিক বুঝে উঠতে পারলনা ব্যাপারটা।   
        পরদিন ভোরে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনে ঘুম চোখে দরজা খুলে দেখল তার বান্ধবী, পেছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে তার বাবা। বান্ধবী তার হাতে বেশ কিছু টাকা দিয়ে বলল, ‘তোর টাকা তোর কাছে রাখ। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তারা চলে গেল। লীলা বুঝে উঠতেই পারল না কীসের টাকা, কার টাকা? পরের দিন স্কুলে বান্ধবীর কাছে জানল ব্যাপারটা। কীভাবে তার বান্ধবী টাকা রোজগার করেছে তা বুঝে  ঘৃণায়  বাইরের ডাস্টবিনে টাকাগুলো ছুঁড়ে ফেলে দিল লীলা।        
      সেদিনই বাড়িতে ঢুকে জানতে পারল বিল বাকি থাকায় ইলেকট্রিক লাইন কেটে দেওয়া হয়েছে। মুহূর্তে লীলা ছুটে গেল ডাস্টবিনের কাছে, তার ছুড়ে ফেলা টাকাগুলো যদি পাওয়া যায়। তন্ন তন্ন খুঁজেও পেলনা। কেউ নিয়ে চলে গ্যাছে।    
       দিন যায়, মায়ের কোনো খবর আর আসে না। একদিন চিঠি এল, কিন্তু মায়ের না, সোশ্যাল ওয়েলফেয়ারের। লীলা দেখা করে জানতে পারল, তার মা তাকে নিজের কন্যা বলে অস্বীকার করেছেন। লীলার জন্য তিনি কিছুই করতে পারবেন না। বাড়িতে এসে লীলা জোড়া দিয়ে রাখা মায়ের ছবি আগুনে পুড়িয়ে দিল। সেও হয়তো তার মাকে এভাবেই অস্বীকার করলো! 

  
       বাস্তবতা লীলাকেও একদিন রঙ মাখিয়ে বান্ধবীর দেখানো পথে নিয়ে গেলজীবনের প্রথম রোজগারের টাকায় বন্ধু ভোলোদার জন্য একটা ভলিবল কিনে আনল। ভোলোদা লীলার থেকে বয়সে বছর দু তিনেক ছোটো। কেউ তাকে বিশেষ একটা পাত্তা দেয়না। মাতাল বাবা প্রায়ই মারধোর করে। নিজের মনে একা একা সে শুধু ভলিবল খেলে যায়। লীলাকে খুব ভালোবাসে। আসলে ভোলোদা লীলার কাছে শুধু আশ্র্য় পায়নি একবার তাকে আত্মহত্যা করা থেকে বাঁচিয়ে ছিল। ভোলোদা মাঝে মাঝে আফশোষ করে কেন তার বয়স দু তিন বছর বেশি হলনা! ভোলোদার জন্মদিনে লীলা কিছু উপহার দিতে পারেনি, কারণ তার কাছে কোনো টাকা ছিল না। প্রথম রোজগারের টাকাতে সে ভোলদার জন্য ভলিবল কিনে আনল। খুশি হলেও ভোলদা লীলাকে প্রশ্ন করল, সে টাকা কোথায় পেয়েছে? লীলা বলল, তার মা পাঠিয়েছে।           
       পার্টিতে একদিন সুন্দর দেখতে একটি ছেলের সঙ্গে লীলার চোখাচোখি হলো। পরে ছেলেটির সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা বাড়ে এবং ছেলেটি তার দেশ সুইডেনে লীলাকে নিয়ে যেতে চায়। সুইডেনে সে লীলার জন্য কাজের ব্যবস্থা করবে। লীলা যেন হাতে স্বর্গ পেল। ছেলেটিই তার পাশপোর্ট ভিসার ব্যবস্থা করল, কিন্তু অবৈধ পথে। পাসপোর্ট হাতে নিয়ে লীলা দেখল অন্যের নামে পাসপোর্ট করা হয়েছে। কারণ হিসেবে ছেলেটি জানাল, যেহেতু তার বয়স ১৮ হয়নি তাই অন্যের নামে করতে হয়েছে। লীলা ঐ নরক থেকে বেরিয়ে যাবার জন্য এতটাই উদগ্রীব যে তলিয়ে কিছু ভাবতেও পারছিল না। শুধু তার একটাই অনুরোধ ছিল ছেলেটির কাছে, সে যেন তার বন্ধু ভোলোদার একটা কাজের ব্যবস্থা করে দেয়। ছেলেটি সম্মত হলো। খুশিতে ফেটে পড়ল লীলা। 
         হয়তো কাফ লাভ’, তবুও ওইটুকু ছেলে ভোলোদা বুঝতে পারছিল লীলার সুইডেনে চলে যাওয়া মোটেই ভালো হবেনা। লীলা যে নতুন বন্ধু পেয়ে মজে রয়েছে, এর পরিণাম খুব খারাপ হবে। লীলা হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলত এটা তোর জেলাসি। ভোলোদা প্রতিবাদ করতো, ‘না জেলাসি নয়। কিন্তু ভোলোদাকে পাত্তা না দিয়ে লীলা সত্যিই একদিন সুইডেন চলে গেলো। যাবার আগের দিন লীলা জানতে পারল, ছেলেটি এখনই তার সঙ্গে যেতে পারছে না, কারণ তার দিদিমা অসুস্থ, দুদিন পর সে যাবে। তবে বস্‌কে বলে সব ব্যবস্থা করা আছে, কোনো অসুবিধা হবে না। একাই লীলা সুইডেন উড়ে গেল। ভোলোদা সহ্য করতে পারল না লীলার চলে যাওয়া। একসঙ্গে অনেকগুলো ঘুমের বড়ি খেয়ে লীলার বাড়ির উঠোনে আত্মহত্যা করল।       
       ‌সুইডেনে পদার্পণের কয়েক ঘন্টার মধ্যেই লীলা বুঝতে পারল ভোলোদার আশঙ্কাই ঠিক, এক বড় চংকার পাল্লায় পড়েছে সে, এবং পালাবার এ্যাতটুকু পথ নেই। এয়ারপোর্ট থেকে তাকে একজন নিতে এসেছিলেন, হয়তো তিনিই ছেলেটির কথামত বস্‌। লীলাকে গাড়ি করে নিয়ে গেলেন একটি বহুতলেফ্ল্যাটের চাবি খুলতে দেখা গেল অজস্র পেপার, হ্যান্ডবিল ইত্যাদি জমে পড়ে রয়েছে দরজার পেছনে মেঝেতে। বোঝা গেল বহুকাল সে ফ্ল্যাটে কেউ আসেনি। লীলাকে ঘরে ঢুকিয়েই বস্‌ কোনো কথা না বলে বাইরে থেকে চাবি লাগিয়ে চলে গেলেন। অন্ধকার হাতড়ে লীলা আলো জ্বালল। তার খিদে পেয়েছে কিন্তু কী খাবে সে জানে না। ফ্রিজ খুলে দেখল, বহুদিনের পচা কিছু রয়েছে। বিকট গন্ধ। আস্তে আস্তে সে সব পরিষ্কার করল। জানালার পর্দা সরিয়ে দেখল অনেক নিচে অচেনা শহরের আলোময় রাস্তা। হুশ হুশ গাড়ি ছুটে চলছে। চুপচাপ এসে সোফায় শুয়ে পড়ল তার প্রিয় মাতা মেরির ছবিটি বুকে জড়িয়ে। 


   
      পরের ঘটনা খুবই সরল। যথারীতি বস্‌ লীলাকে প্রথম ভোগ করলো, তার পর তাকে সাজিয়ে রোজ সন্ধ্যায় একের পর এক খদ্দেরদের কাছে লেলিয়ে দিয়ে টাকা রোজগার করতে থাকল। এই খদ্দেররা সবই কিন্তু মধ্যবয়সী পুরুষ, কেউ কেউ বৃদ্ধও। নাত্‌নীর বয়সী ফুটফুটে মেয়েটিকে উপর্যুপরি ধর্ষণ করেই গেল এক একজন 

         ওইটুকু মেয়ে কি বা করতে পারে বিদেশ বিভুঁইয়ে! যে সোফাতে সে ঘুমোত, সেটাও যেন অসহ্য কন্টকময়। বিছানা মানেই যেন ভোগের প্রতীক। টেবিলের উপর চাদর বিছিয়ে তলায় গুটিশুটি হয়ে শুয়ে পড়ল একদিন। স্বপ্ন দেখল, ভোলোদা এসেছে তার পাশে। লীলা বলল দুঃখিত, ওই ভাবে তোকে ছেড়ে চলে এসেছি। ভোলোদা বলল, 'ওটা কোনো ব্যাপার না'‘তুই-ই আমার একমাত্র বন্ধু'ভোলোদা বলল, 'আজ ক্রিসমাস, তোর জন্য একটা উপহার এনেছি।' কী উপহার?’ ‘দেখ সামনে।সামনে খোলা আকাশ। লীলাকে ছাদে নিয়ে এসেছে ভোলোদা। ভোলোদার পিঠে পাখির ডানা। লীলা বলল, 'কই আমার উপহার?'এই খোলা আকাশ, এই শহর, রাস্তা, সমস্ত বাড়ি, যানবাহন, পুরো পৃথিবীটাই তো তোর।' ক্যামেরাকে ধরা হলো এক বহুতলের নিচ থেকে। কার্নিসে ভোলোদা আর লীলা পাশাপাশি বসে রয়েছে। লীলা বলল, ‘আমি তাহলে এখান থেকে ঝাঁপ দিয়ে উড়ে চলে যাই?’ ‘না না, এটা করিস না।’ ‘কেন? এটা আমার ইচ্ছে।’ ‘আমার আর বাঁচতে ভালো লাগছেনানা না, আমিও তাই ভেবেছিলাম, আত্মহত্যা করে স্বর্গে এসে দেখলাম, খুবই সুন্দর, কিন্তু বেঁচে থাকা বোধহয় তার থেকেও সুন্দর’! 
Puberty_(1894-95)_by_Edvard_Munch
   
       অসাধারণ এই প্রতীকী কথোপকথনের মধ্যে বসের চিৎকারে লীলার স্বপ্ন ভেঙে গেল। বসের হুকুম, এখনই যেন সে সেজে বেরিয়ে পড়ে। আবার রাতের খদ্দেরের কাছে বস্‌ নিয়ে চলল লীলাকে। একবার রাস্তায় বসের অসতর্কতায় লীলা ছুটে পালাতে গেল, কিন্তু অপরিচিত শহরে লীলাকে পাকড়াও করতে বসকে বিশেষ বেগ পেতে হলো না। বসের প্রচন্ড প্রহারে লীলার মুখ ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেলোটানতে টানতে আধমরা লীলার শরীরটাকে ছুঁড়ে ফেলে রাগে গর গর করতে করতে বস্‌ বেরিয়ে চলে গেল। আবার স্বপ্নে ভোলোদা এসে লীলাকে জানাল, বস্‌ দরজায় চাবি দিতে ভুলে গ্যাছে। লীলা এখুনি যেখানে খুশি পালায়! চোখমেলে দেখল ভোলোদা নেই, কিন্তু সত্যিই দরজা খোলা রয়েছে।  
picasso

        
       লীলা বেরিয়ে পড়ল, কিন্তু ওইটুকু মেয়ে যাবে কোথায়? বস্‌ হুমকি দিয়ে রেখেছে, লীলা পুলিশের কাছে গেলে, পুলিশ তাকে বাড়ি পাঠিয়ে দেবে ঠিক, কিন্তু সেখানে তার লোক ওকে মেরে ফেলবে। লীলার মা নেই, তবে কী তার মাকেও তার মতো বেচে দেওয়া হয়েছে? থাকার জায়গা নেই। একমাত্র ছোট্ট বন্ধু ভোলোদাও নেই। সে কোথায় যাবে তবে? উদ্‌ভ্রান্তের মতো এদিক সেদিক ছুটতে থাকে। পুলিশের গাড়ি দেখলে লুকিয়ে পড়েএই অজানা দেশে কোথায় বা যাবে ওইটুকু মেয়ে?  
       হাইওয়ের ওভার ব্রিজ থেকে রাস্তায় ঝাঁপ দিল লীলা। হতভাগিনীর ওই একটাই পথ খোলা ছিল। ছোট্ট বন্ধু ভোলোদা পাখা মেলে উড়ে এসে তাকে ঝাঁপ দিতে বারণ করলেও লীলা কর্ণপাত করলো না।

    
      হাসপাতালে লীলার মৃত্যু হলো।  
পরের দৃশ্যে লীলা আর ভোলোদাকে ডানা মেলে সারি সারি বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানার ছাদে ছাদে উড়ে বেড়াতে দেখা গেল মুক্ত বিহঙ্গের মতো।


সমাপ্ত


        ডাউনলোড করা এ ছবি একাই দেখেছিলাম নিজের ঘরে। কি এক অব্যক্ত কষ্টে বুকের ভেতর দলা পাকিয়ে উঠছিল। কোনো ভালো শিল্পের সামনে দাঁড়ালে যে অনুভুতি হয়, চিরন্তন যে শিল্প মনকে আনন্দে আচ্ছন্ন করে রাখে! না সে অনুভুতি হয়নি। এ কাহিনি এমন একটা বাস্তবের আয়নার সামনে দাঁড়করিয়ে দিল, বার বার যেন আয়নার ভেতরের প্রতিবিম্ব আঙুল তুলে বলছে তুই পুরুষ। পুরুষের রক্ত তোর শরীরে বইছে।প্রাকৃতিক কারণেই সে রক্তকে আমি চাইলেও এড়াতে পারি না! অনেকে হয়তো ভাববে একটা সিনেমা এভাবে কারও অনুভূতি জাগাতে পারে? অবশ্যই পারে না। হয়তো কোথাও একটা জমি তৈরি ছিল। আমি হয়তো তেমনই একজন হতভাগ্য যাকে বাস্তবিকই এমন দু একটি নারীর অবমাননা, বঞ্চনা খুব কাছথেকে দেখতে হয়ছে। অসহায়ভাবে শুধু তাকিয়ে থাকতে হয়েছে। নিষ্ঠুর নিয়তি নিষ্ঠুর পরিণতির দিকে কেমনকরে টেনে নিয়ে চলেছে, চেয়ে চেয়ে দেখতে হয়েছে! খ্যা খ্যা হেসে বলতে পারি না, ‘আমি নেগেটিভ দেখি না, আমার দৃষ্টিতে শুধু পজিটিভই ধরা পড়ে।সত্যিই তো পজিটিভদেখার ভাগ্য নিয়ে আমি জন্মাই নি!          
        কেউ এমনও ভাবতে পারে এ তো ব্যক্তিগত অনুভূতি, শিল্পের সঙ্গে কী এর  সম্পর্ক? ঠিক তাই। আমিও সে ভাবনা থেকে লেখা শুরু করেছিলাম। শিল্পের কথা বলতে চাইনি। কিন্তু কখনো শিল্পের থেকেও মহা মূল্যবান হয়ে পড়ে এমন বাস্তবের দর্পণ। জানিনা এ ছবির পরিচালক ঠিক কোন ভাবনা থেকে এমন একটি অ-শিল্প দর্পণ আমাদের কাছে তুলে ধরলেন! আমি যে কতটা পুরুষ বা কতটা পুরুষের রক্ত আমার শরীরে প্রবহমান তার বড় প্রমাণ আমি একা এমন একটা ছবি দেখতে পেরেছি। আমি নিশ্চিত যা কোনোভাবেই সুস্থ একজন নারীর পক্ষে একা দেখা সম্ভব হতো নাকোনো সুস্থ মানসিকতার মা হয়তো কেঁপে কেঁপে উঠবেন এ ছবি দেখে। আর্ট নিয়ে আলোচনার টেবিল চাপড়ানির শব্দে মুখর হবে না, কিন্তু চোখের ঠুলি সরিয়ে এফোঁড় ওফোঁড় করে দেবে সব        

          এ তো নতুন নয়, অজস্র এমন ছবি হয়েছে। এ ঘটনাও নতুন নয়। পৃথিবী জুড়ে প্রতিনিয়ত হাজার, লক্ষ কিশোরি থেকে যুবতী নারী পাচার হয়ে যাচ্ছে। মানি আর না মানি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সমস্যা নারীদের অবস্থান। হাজার হাজার বছর ধরে আমারা উন্নত থেকে উন্নততর হয়েছি, হয়ে চলেছি। টেকনোলজি এখন আষ্টেপৃষ্ঠে আমাদের জড়িয়ে রেখেছে কিন্তু এমন একটা টেকনোলজি আজ পর্যন্ত কেউ আবিষ্কার করতে পারল না যার কল্যানে নারীর প্রতি পুরুষের দৃষ্টি অমলীন থাকবে। বই পড়া বিদ্যে নয় সত্যিই নারীকে সমান ভাববে। নারী স্বাধীনতার গলাবাজি করতে হবে না। নারী-কল্যানের জন্য হাজারো সমিতিউপ-সমিতি গড়ে তুলতে হবে না! কিন্তু বাস্তব? বাস্তব এমনটা বলে না, বলে না বলেই এমন ধরণের ছবি মাঝে মাঝেই কাউকে করতে হয়।     
             ব্যক্তিগতভাবে এ ছবিতে একটা উল্লেখযোগ্য দিক আমার চোখে পড়েছে। প্রায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নারীর অসম্মানের কথা বলতে গিয়ে আসলে নারীকেই অপমান করা হয়এমন কিছু দৃশ্য দেখানো হয় যেখানে আর একভাবে নারীকে পণ্য হিসেবে দেখতে এবং পুরুষের কাম বৃদ্ধিকেই ত্বরাণ্বিত করে। লীলার কাহিনিতে আর যাইহোক সেভাবে ওই বাচ্চা মেয়েটিকে অপমান করা হয়নি। উন্নত দেশের নারী স্বাধীনতার নামে আসলে নারীদেহ প্রদর্শন করিয়ে বাজার পাকড়াওর সহজ পথে এ ছবি হাঁটেনি। কিন্তু পুরুষের নির্মম, ভয়ংকর পৌরুষ, কামনা যথার্থভাবেই দেখানো হয়েছে। হয়তো সে কারণেই শিল্পসম্মত হয়নি এ ছবি। পৃথিবী বিখ্যাত পরিচালকদের খুল্লামখুল্লা নারী দেহ প্রদর্শন শিল্পের একটা সাহসী দিক কিনা! পৃথিবী বিখ্যাত ছবির পাশে লীলার কাহিনি হয়তো থাকবে না, কিন্তু এ ছবির নির্মম সত্যকে কোনো পুরুষ অস্বীকার করতে পারবে না।






আমার এই দুটো ছবির নাম 'Damini-01', 'Damini-02'   দিল্লির 'নির্ভয়া' ঘটনার পর আঁকা (২০১২)   



2 comments:

  1. khoob valo lekha, chhobidutir motoi sabolil.

    ReplyDelete
  2. PradoshDa lekhar gunogoto maan 3star,5star diye bichare jawata aontoto amar kache murkhamir samil. Aar ami mone hoi otota murkho noi. Prothomei asi cinemar mul boktobye- Apnar bornona ebong bislesone jototuku upolobdhi korlam(janina parlam kine purotai upolobdhi korte) tate amar baktigoto upolobdhite cinema-ti amar dekha hoye gelo!Ei dhoroner golper potobhumikai aageo kichu hoito dekhechi. Kintu apner angike eto sukhyati-sukhyo vabe bisleson korte parini ba, cinemar gulir presentation nara dei ni. Ojosro laila to protidini "Laila" hochhe. Somosya ta sudhumatro purush-kedrik somaj bole noi. Ei somosya nari-rao jorito. Aasole proper education hoina edeshe! Punthigoto sikhyai sudhumatro patheo hisabe dhora hoi. Ekti manush "manush" er porjai aste gele bisesh kichu gun, o bisesh kichu obhyas tayag korte hoi. Amra nijerao er dhare kache jaina ebong keuke insist-o korina. Sudhu "Nirvaya" kano, proti-muhurte erokom osikhya-kusikhyai vora jibon-japon dhora porche chokher samne! Eysob manusher sonkhya eto bere geche je amra oti nogonyo. Protibad korben se unity kothai? Tai aajo 4.6yrs poreo "Nirvaya" case ekhono continue... Je sobtheke nrisongsotar porichay diyeche,n se nabalok hisabe sodhonagare giyeche. Ki odvut ! Ekhon aar raag korte parina, sudhu ghrina hoi, ghrina !!!

    ReplyDelete