মজনু শাহ |
জন্ম
২৬ মার্চ ১৯৭০, উত্তরবঙ্গে। এপর্যন্ত প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ — আনকা মেঘের জীবনী (১৯৯৯),
লীলাচূর্ণ(২০০৫), মধু
ও মশলার বনে (২০০৬), জেব্রামাস্টার (২০১১), ব্রহ্মাণ্ডের গোপন আয়না (২০১৪),
আমি এক ড্রপআউট ঘোড়া (২০১৬)। একটি
রাসায়নিক কারখানায় কর্মসূত্রে ইতালি আছেন।
রুটিগাছ
রুটিগাছ তলে বসে সারারাত দেবনিন্দা করি—
রাতের
বাগানে ঢুকে স্মৃতিগুলো বাদুড়ের মতো
নষ্ট
করে ফল,
দেখি, ডুবে যাচ্ছে কর্দমাক্ত পথে
গরুর
গাড়ির চাকা, সাত মিনিটের আয়ু নিয়ে
এক্ষুনি
জন্মালো কেউ, তুমি কেন অস্থির কুসুম?
আজ
সুফি-ধূলিকণা যত আছে এখানে ওখানে
বাতাসে
গভীরভাবে অন্ধ হতে হতে উপস্থিত।
ভ্রমণশীল
উদ্ভিদ,
এত কেন ভয় হেমন্তকে?
ভ্রমণশীল
পাহাড়,কার হাত থেকে ঐ রুটি
গর্ধবের
পিঠে জমা হয় তুমি তার কিছু জানো?
গরম
রুটির গন্ধ-ভরা এই আয়না-সমাধি
কেন
যে পাহারা দেই আমি আছে যদি এত বুলবুলি,
রক্তাক্ত
সমাধানের দিকে এত কারা ছুটে যায়,
তস্করতাপূর্ণ
চক্ষু মুদে ফের ধূলিকণা হও—
পেখম
আমাকে
নিক্ষেপ করো পৌরাণিক গল্পের অরণ্যে
একটি
বিন্দুর মতো, শোনো, আর কিছু চাইব না।
কোথাও
রয়েছে প্রশ্ন প্রহরীর স্খলিত নিদ্রায়,
সেইসব
দেখি আর থমকে থাকি ঘাসের পাখায়
তারার
ধুলোর মতো,
তারারশ্মি, তুমিও নশ্বর!
আমি
কি পেখম এত বয়ে নিতে পারি মহাকাল
যেখানে
করুণ ছায়া ছায়াজাল আহা জালখানি
ক্রমশ
জড়ায় অঙ্গে! যতিচিহ্ন ছড়ানো জঙ্গলে
আজ
কোথা থেকে এত তুলো উড়ে আসে ওগো হেম
ওগো
রক্তমাখা বীর, কোনো যোনিপুষ্প ঢেকে দিতে
আমাকে
বলো না আর, শাদা স্তব্ধ পিয়ানোর কাছে
আমার
কবিতা তবু মূর্চ্ছা যেতে যেতে জেগে ওঠে,
তখনও
দূরের গদ্য থেকে অপরূপ ফুল্কি উঠছে
ধ্বসে
পড়ছে দেখো ধুলো হচ্ছে ক্রমে লেখার টেবিল।
উপক্রমণিকা, জেব্রামাস্টার
A Poem is never finished, only abandoned
—Paul Valery
আজ
আমার সকল সৃষ্টিছাড়া পংক্তির গায়ে বিকেলের ম্লান স্বর্ণচ্ছায়া এসে পড়ুক, কিম্বা তার পাশে জ্বলে উঠুক শুকনো পাতার স্তূপ। ব্যাধ ফিরে এসে দেখবে, ছাই উড়ছে শুধু।
কতটুকু
সত্য কাছাকাছি আসে আনন্দের? তীর্থ-বিতাড়িতদের বলি, ভাঙা বেহালার মধ্যে আমার সমস্ত পাপ ঠেসে ভরাতে চেয়েছি।
এখন
ফিরে আসুক সেইসব পাখিরাও, মৌরিজঙ্গল ছেড়ে, একদিন যারা উড়েছিল সাগরের পথে।
ভয়াবহ
স্তব্ধ কোনো রাতে, জেনেছ, প্রতিটি চুম্বনের পর, এই কুহকী অস্তিত্বের ভার কিছুটা কমে আসে। ঝুটিওয়ালা মোরগ আর বীণা—এই ছিল আমাদের অন্তিম সম্পদ। কেন তবে হারিয়ে যাও জেব্রাদের উন্মাদ-দৌড় শুরু
হলে! একটু দাঁড়াও যদি, দেখতে পাবে, মৃত পাতা মৃত ফুল ছড়ানো পথের
কিনারে,
ভোরবেলা দীর্ঘ কোনো গাছের গা বেয়ে কীভাবে একটি
নিঃসঙ্গ শিশির মিশে যায় মৃত্তিকায়, ধীরে।
দেখ
আরও, আমাদের জলপাইগাছে মাঝে মাঝে কিছু অচেনা পাখি এসে বসে, যাদের সহস্র বছর আগে বা পরের দার্শনিক বলে ভ্রম হয়।
রাজকুমার
রাজকুমার
আমার বন্ধু। তার অশ্রুময় ও আগ্নেয় কথাবার্তা, এক অস্পষ্ট মৌচাক। অনেকের মতো, আমিও তাকে বুঝতে পারি না। কোত্থেকে এই এসে কথা বলছে হেসে, পরক্ষণে, চলেছে সুদূর। সত্য, বারবিকিউ, পাপ, বাজপাখি, তীর্থ, ধূলি... জাগতিক এমন সমস্ত কিছু তার প্রশ্নের আওতায়। একবার নাগাসন্ন্যাসীদের
মাঝে কাটাল কিছুদিন। ফিরে এসে বলল,
‘সিংহের থাবার ভেতর আরও এক হেমন্ত
থাকতে হবে তোমায়। ডুমুরগাছ থেকে তাই এক্ষুনি নেমে এসো। তারপর, মুখস্থ করো আট হাজার আটশ কূটশ্লোক। শূন্যতার সংসারে, কত আর ভক্ষণ করবে বৃষের পুরীষ! যেখানেই শয়ন করো, সবই রণভূমি। তোমার দিকে তাকিয়ে আছে একচক্ষু দানব, তুমি তার রসনার উপযুক্ত হও’—
আমার
দুঃখও কিছুটা মহাজাগতিক— এ-কথা তাকে বলেছি যেই, অমনি রাজকুমার ধুলো-ওড়া প্রান্তরের দিকে চলে গেল ফের। কোনো ব্যাখ্যা বা
অনুরোধ,
শুনতে চায় না সে। আমার কারবার রুটি ও রাইফেল নিয়ে, এসবের বাইরে, কেন যে আমি ওর সঙ্গে কান্ট-হেগেল মারাতে গেলাম! সমস্ত
জ্ঞেয়বস্তু দুর্জ্ঞেয় হয়ে উঠছে এই হেমবর্ণ দুপুরে। অসংশোধিত কবিতার মতো পড়ে আছে
সামনের অরণ্য ও ভগ্নপ্রায় সমাধিগুলি।
অস্তিত্ব
অস্তিত্বের
রঙ কী, মাঝে মাঝে ভাবি। যেমন কোনো রাজমহিষীকে দেখি নি কখনো, তবু তার মুখের রঙকাহিনি মনে পড়ে। ঐ হাবা অরণ্যের পাশে, চুম্বকের বিছানাই আমার সব। রাত্রিবেলা, প্রান্তরে, দেখা দেয় মহাজাগতিক ডিম। হারেমের রূপসীরা সেই দিকে দৌড়াতে থাকে। সবাই রঙ
পেয়েছে,
রসিকতাও। কেবল এই বহু ছিদ্রময় অস্তিত্ব, প্রতিমুহূর্তে অস্বীকার করে রঙ, আর সর্বত্র কায়েম রাখে তার
অট্টহাসি। সেদিন সাপরাজার সাথে দেখা, বৃত্তান্ত শুনে বললেন, এইসব রেখে, কিছুকাল মেঘে মেঘে পায়চারি করুন—
*
রক্তবর্ণনার
ভিতর দিয়ে যাই। হে অভিরূপ, তুমি কোন্ পাখি? নির্জন ঘাটে শুয়ে কেউ কেউ ক্ষয় হয়ে যায়। মাছরাঙা একপ্রকার আলোজাদু। কাব্যের, ইশারার সমস্ত বীজ, জবাকুসুমের মুখ থেকে শুনি। আমার
মৃত্যুচিন্তা মুদ্রিত আছে ঐ কাঠবাদামের গায়ে, কাঠবেড়ালি আজ সকাল থেকে তার দিকে
তাকিয়ে রয়েছে। যত অদ্ভুত আলো দেখ, সবই মাছরাঙাটির।
*
যে-কোনো
সুদূরকে আজ অপরাহ্ন বলে মনে হয়। যে-কোনো প্রণয়, বল্মীকস্তূপের
প্রায়। অতি শাদা ফুলের রাত্রিসংলাপ ছুটে যায়কার পানে! মনে রেখ ঘাসেদের বিপুল
অভ্যর্থনা,
পতঙ্গদের মৃত্যুনাচ। আমার সবুজ অক্ষরগুলো ধুলোয়
ঘুমায়। বাঁকা পথ দিয়ে যেতে যেতে কিছু শশীবাক্য আজ তোমায় শোনাতে হলো। আগামী কোনও
ঝড়ে হাতি,
হিতোপদেশ সবই হয়ত একসঙ্গে উড়বে।
দেবতাদের সঙ্গে
এমন
দেবতার সঙ্গে দেখা হলো, আধ-শোয়া হয়ে দিনরাত শুধু পড়ে, আর চিড়া-দই খেতে খেতে লাঁকার কথা বলে। সেসব শুনে মনে হয়, লাঁকাতেই বুঝি সর্বপরিত্রাণ। ক্রদ্ধ মেঘগুলো তখন দ্বিতীয় একটা আকাশের কথা
ভাবে, আর ভেসে যায়। পৃথিবীর বাইরে, পৃথিবীর দরজা খোলার সাত-আটশ চাবি
পড়ে আছে,
এগুলো লাঁকার, এমন কি সব গর্ভবতী বেড়াল,ক্লান্ত উট ও গাঢ় জ্যোৎস্নার মালিকানাও জাঁক লাঁকার।
*
আমার
অনুষঙ্গে,
এত কেন অহিফেন মাখাচ্ছ, মমতা, দেখ তুলোর বেড়াল, সেও বুঝেছে এইসব। চারপাশে ধোঁয়া ও
চুমুর শব্দ। মনে পড়ে কোনো এক নাম ভুলে যাওয়া দেবতার ভ্রূকুটি সৌন্দর্য। বস্তুত, অজস্র জালালি কবুতরের ডানা ঝাপ্টানির ভেতর পড়ে আছি। তোমার যা কল্যাণ, সুফিকবুতর হে, আমার নয়। চিন্তাপুষ্প, রায়বাঘিনী— কোন্ দিকে ধাই! রয়েছে সামনে ময়দানব, আর তার মেলে-ধরা রাত্রিখাতা।
*
তোমার
তীর, অর্জুন, আজো অশান্তির বাতাস ভেদ করে ছুটে চলেছে। ক্রমাগত এক
পাগলা হাতি সমস্ত বিকেল জুড়ে তার শুঁড় নৈরঞ্জনা নদীতে চুবিয়ে পূর্ণ করে তারপর ছুড়ে
দিচ্ছে ঊর্ধ্বে বসানো ঐ অচিহ্নিত আসনের দিকে। তোমার তীর, এইমাত্র সেই ফোয়ারা আর বিলীয়মান রামধনুকে ভেদ করে গেল। পৃথিবীকে ফুঁড়ে, চিরনক্ষত্রের পাশে থেমে যাবার আগে, অর্জুন, তোমার লক্ষ্যভেদের তালিকায়, আমারও দু’একটা সামান্য বিষাদ যোগ করার ছিল।
আমার ভাষা
আমার ভাষা তৈরি হয়
সেই নির্জনতায়, জেব্রা
যেখানে তার শাবকদের নিয়ে খেলা করে। বহু খুঁজে, পেয়েছি পেজমার্কার,
একটি উজ্জ্বল বিয়োগচিহ্ন আর ডালিমফুলের ছায়া। বন্ধ দেয়ালঘড়ির দিকে তাকিয়ে, লিখতে শুরু করি। একদিকে অসানোগ্রাফির
ক্লাশ, অন্যদিকে তোমার সঙ্গে
সাঁতার কাটার ইচ্ছে। তাসের ঘরে এলেই প্রশ্ন করো, আমি কি তুলোরাশির জাতক? ঘর অন্ধকার করে শুধাই, তুমি কি কাননবালা?
প্রশ্নেরা আজ হাসির কারাগার যেন। তোমার শরীর থেকে তখন ঘাসের গন্ধ আসে।
জানালা খুলে দেই অতঃপর শান্ত হাতে। পাখিবাজার থেকে ফেরে লাঞ্ছিত লোকজন, নক্ষত্রের আলো আসে আমাদের তাসের ঘরে।
মূল বুদ্ধ
জ্যোতির্ময় ঘুঘুদের
সাথে, আমবাগানে, ছুটি শেষ হলো।
বস্তুত এদিকে
এসেছিলাম তোমাদের অন্ধকূপ দেখব বলে। এসে দেখি হরবোলাদের তাঁবুগুলো ফুলে উঠছে ক্রমে, আর,
সাত সেকেন্ডের সেই মরুনাটক,
যাতে মূল বুদ্ধ ফিরিয়ে দিচ্ছেন তেত্রিশ বুদ্ধকে। এখন নির্বাণ নির্বাণ করো
না। সুজাতা সুজাতা করো না। কেউ ঘুমোচ্ছে পাণ্ডুলিপির তলে, কেউ রইল উঁচু মেঘেদের আস্তানায়। মাঝে
ভাসছে স্বরবর্ণগুলো। কাঁকড়া-ভাজা খেতে খেতে উপন্যাস পড়ছে কেউ। নারীদের এলোচুলে
ঢাকা থাকে যেসব উপন্যাস—
পড়তে পড়তে আমারও মনে
পড়ে সাপঘরের কথা। পাতলা ক্ষুরের মতো চাঁদ,
আজ যা ইচ্ছে বলো। ব্রহ্মাণ্ডের গোপন আয়না হয়ত এরই ভেতর হাত-বদল হয়ে গেছে।
আয়নার মুহূর্ত, মূল
বুদ্ধের জন্য, তার মনের
ভেতর সাতটি আকাশ। বলো বুদ্ধ, বলো
বার্তাবাহী মেঘ, এই
অর্ধক্ষয়িত রঙপেন্সিলের বাক্স দিয়ে আমি কী করব।
দাম্পত্য
যখন তুমি মেয়েমানুষ
থেকে দূরে আছ, পড়তে পার
চিহ্নবিজ্ঞান, চাঁদের
নিচে ডিগবাজি খেতে পার কিছুক্ষণ বা বানাতে পার চাবুক। আসলে তোমার জন্যে কোথাও
অপেক্ষা করে আছে কাঠবেড়ালি, তার বগলে
এ বছরের রাশিফলের বই, আর অন্য
হাতে সেক্স-পিস্তল।
যখন তুমি পুরুষমানুষ
থেকে দূরে আছ, খাও যত
ইচ্ছে পপকর্ণ, নিজের
ভয়ংকর গোপন কথাগুলো নিজেকেই আরেকবার শোনাও ফিসফিস করে। একখানা জ্যান্ত কবিতার বই
সঙ্গে রেখ, তোমার
দিকে এগিয়ে আসা বিচ্ছুগুলো পিটিয়ে মারার জন্য ওটা লাগবে। খবরদার, ভুলেও বেড়াল কোলে নিও না, যা দিনকাল পড়েছে, স্তনে আঁচড় দেবার ঘটনা গত পরশুও ঘটেছে
ভূতের গলিতে। এ সময় ইউক্লিডের উপপাদ্যগুলো মনে আছে কিনা, সেটা আঙুল দিয়ে লিখে দেখতে পার বালিতে।
ক্রম
বিলীয়মান জগৎ থেকে
যেন
কিসের গন্ধ আসে।
কোনো
দস্যুপাখির ঝাপটানো পাখার?
লুপ্ত
কমলালেবুর?
লুপ্ত
বাঙলা হরফের?
নাকি
সাতজন প্রণয়ভিক্ষুক পাহারা দেয় যে-বাগান,
তার?
(বিভাগীয় সম্পাদনা : সোনালী চক্রবর্তী)
No comments:
Post a Comment