বাক্‌ ১১১ : সম্পাদকীয়




অনুপম বলছি


।। জীবন আর কবিতা, কি কখনোই ১ হয়ে যেতে পারে? কারো জীবনেই কি হয়েছে? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যখন তিনি কন্যাদায়, জমিদারি, ব্রাহ্ম সমাজ, জাতীয় কংগ্রেস, জামাইয়ের অভদ্রতা ইত্যাদির মোকাবিলা করতেন, তখন কি ১জন কবি হিসেবেই সেটা করতেন? জীবনানন্দ দাশ যখন চরিত্রহীনা একজন ভাড়াটিয়াকে উচ্ছেদ করার জন্য পরিচিতমহলে গুন্ডার খোঁজ করতেন, বা চাকরির জন্য কাতর চিঠিগুলো লিখতেন, তখন কি তিনি ধূসর পাণ্ডুলিপি বা সাতটি তারার তিমিরের কবি থাকতেন? আর্তুর র‍্যাঁবো যখন ক্রীতদাস আর বন্দুকের ব্যবসা করতেন? এই প্রশ্নের সরল উত্তর হবে না। জীবন বা কবিতা, কোনোটাই অত সরল নয়, হয়ত জটিলও নয়। সরলতা আর জটিলতা ১ই ব্যাখ্যা থেকে উঠে আসে। জীবন বা কবিতা, সময় এবং স্থানকে অনড় পাথরের মতো দখল করে রাখে না। স্মৃতি আর অভিজ্ঞতার অবিরাম রূপান্তরের মধ্যে ১জন কবি বাঁচেন। যা হয়েছে তার স্মৃতি, তার অভিজ্ঞতা শুধু নয়, যা হয়নি তারও স্মৃতি। যে কোনো পাথরের বুকে থাকে রূপের তৃষ্ণা, আকার নেওয়ার অনিবার্য ইচ্ছা, এবং তা তাকে যন্ত্রণা দেয়। ছেনি আর বাটালির যন্ত্রণা। ক্ষয়কারী হাওয়ার যন্ত্রণাধারালো জলের যন্ত্রণা।

।। এবং, কে না জানে, যন্ত্রণা আর আনন্দের মধ্যে দূরত্ব ঠিক ততটাই, যতটা কবিতা আর জীবনের মধ্যে। ১জন কবি যখন ধার নেওয়ার জন্য মহাজনের গদিতে নতজানু হয়ে বসে আছেন, অথবা তিনি যখন কোনো দেহবিক্রেতার সঙ্গে যৌনতার দর কষাকষি করছেন, রিক্সাচালককে তার প্রাপ্য দিতে চাইছেন না, অথবা বিপন্ন কাউকে দেখেও কাপুরুষের মতো পালিয়ে যাচ্ছেন, তিনি কবি হিসেবেই সেগুলো করছেন। কবি হওয়ার জন্য দেবতা হওয়া লাগে না। মিলিটারি ট্রেনিং নিতে হয় না। নির্ভীক মানুষের চেয়ে ভীরুর অধিকার সেখানে কম নয়। নিষ্কামের চেয়ে কামুকের অধিকার কম নয়। শুধু দোষে গুণে ভরপুর এমন একজন মানুষ হতে হয় যাঁর মধ্যে সংবেদনগুলো লজ্জাবতী বা কলসপত্রীর চেয়েও উন্মুখ, ও কাতর তিনি, ভালো খারাপের বাইরে। তাঁর জায়গাটা তপশ্চর্যার নয়, ইন্দ্রিয়দমনের নয়, বৈরাগ্যসাধনের নয় ভালো কবি হওয়ার আগে ভালো মানুষ হতে হয়- এই কথা আমরা অনেকের মুখেই শুনি। কিন্তু ভালো মানুষ কি আজন্ম ভালো? তার কি রূপান্তর নেই? ভালোর মূল্য জেনে কি সে ভালো হয়েছে, নাকি ভালো না হয়ে তার উপায় ছিল না? বাল্মীকী হয়ত এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন।

।। সাধক আর তপস্বীর মধ্যে যে পার্থক্য, একজন সারাজীবনের কবিতাশ্রমিককে বুঝতে হলে আমাদের খেয়াল রাখতেই হবে। ওই পার্থক্যটাই রামকৃষ্ণকে কবি নয়, দেবতা করেছে, কারণ তিনি নির্গুণ নির্বিকার ছিলেনরবীন্দ্রনাথকে কবি করেছে, মানুষ করেছে, যিনি সগুণ, বিকার যাঁকে স্পর্শ করত, ময়লা করত না কবি, পৃথিবীর ধুলোয় লুটোপুটি খাবেন, তাঁর লেখার ঘর আসলে তাঁর কাজের ঘর লেখা- ১টা কাজ। শখ নয়। উদ্যানচর্চা নয়। কাজ। মানুষটা ভালো হলে কাজ ভালো হবে? ক্যারাভাজ্জিও নামক শিল্পীটির ছবি আমাদের যে উদ্বেল করে, তাঁর ব্যক্তিজীবন কী ছিল? ক্রিস্টোফার মার্লো কি ভালো মানুষ ছিলেন? না। ভালো মানুষ হলেই কেউ কবি হয় না। আবার, কবিতা লেখার জন্য মাঝরাতে ফুটপাত বদল করাও দরকার হয় না। সুস্থ স্বাভাবিক দোষে গুণে ভরা মানুষ হলেই চলে। ১ জন ছাপোষা বিহারীলাল মজুমদার বা স্বদেশ সেন হলেই চলে।।

                                                                                       (চিত্রঋণ : ভোর মুখোপাধ্যায়)

5 comments:

  1. কবি হওয়ার জন্য দেবতা হওয়া লাগে না। মিলিটারি ট্রেনিং নিতে হয় না। নির্ভীক মানুষের চেয়ে ভীরুর অধিকার সেখানে কম নয়। নিষ্কামের চেয়ে কামুকের অধিকার কম নয়। শুধু দোষে গুণে ভরপুর এমন একজন মানুষ হতে হয় যাঁর মধ্যে সংবেদনগুলো লজ্জাবতী বা কলসপত্রীর চেয়েও উন্মুখ, ও কাতর । - ভরসা পেলাম। এ লেখাটা কাঁপিয়ে দিল।

    ReplyDelete
  2. প্রত্যেক ভাবনারই দ্বিমুখী বার্তা আছে। যে যেমন ভাবে নিজেকে পথ দেখাতে পারে তার কাছে সেটাই পথ। আসলে কবিতা লেখার জন্য আগে ভালো মানুষ হওয়া দরকার, এ কথাটি বড়ো আপেক্ষিক। ভালো মানুষের সংজ্ঞা কেউ নির্ধারণ করতে পারেন না। কবিতা আর জীবন এক হতে পারে না ঠিকই,কবিতার দর্শন ও শিল্পরূপ জীবনকে ছাড়িয়ে যায়। খুব ভালো লাগলো ভাবনাটি।

    ReplyDelete
  3. যুক্তি আছে কথাগুলোয়। আমিও এভাবেই ভাবি। উদাহরণ বাড়ানো যায় অসংখ্য। বিভূতিভূষণ সুদের কারবার করতেন।

    ReplyDelete
  4. লেখাটা পড়ে ভাল লাগল। তোমার অন্য লেখাগুলোর মতই বলিষ্ঠ। সম্প্রতি বিনয় মুখোপাধ্যায় কে নিয়ে তোমার লেখাতাও পড়লাম। যুক্তি তোমার নিজস্ব। তবে গ্রহন করা যায়। -- হৃষীকেশ।

    ReplyDelete
  5. ভীষণ মৌলিক একটি প্রশ্ন তুলেছেন অনুপম। শিল্প বা কবিতা বনাম জীবনের সামাজিক নৈতিক সাধারণ মূল্যবোধ। ের থেকে অনেক চিন্তা ও তার অনেক শাখা প্রশাখা ছড়ায়। আমদের ভাবতে উদ্বুদ্ধ করে। ধন্যবাদ সম্পাদক।

    ReplyDelete