বাক্‌ ১১১ : দেবাশিস ভট্টাচার্য




দ্রোহকাল

“আমাদের একটা বসার ঘর ছিল, যার দক্ষিণের জানালা দিয়ে একটা পুকুর দেখা যেত তার চারিদিকে তালগাছ সুপারিগাছ, বসার ঘর নামেই সেই ঘরে কি না হত শোয়া বসা গান বাজনা পরচর্চা ভূতের গল্প একে অন্যের পিছনে লাগা, সারা পরিবার বেড়াতে গেলে সেটা আমার শোয়ার ঘর হয়ে যেত, তখন একা একটি বই নিয়ে জানালার ধারে মাদুর পেতে ... মজার কথা হল সেই পুকুরের জলে আমি প্রথম আমার ব্যর্থ কামনার ছায়া দেখে ফেলেছিলাম। অবশ্যই কৈশোর কালে, যখন মাছ বা ছায়া ধরতে জাল ফেলার প্রয়োজন হয় না, চক্ষু মুদলেই করতলে উঠে আসে।”

এইটুকু লিখে চোখ বুজলাম। মাথার ভিতর দিয়ে একটা ট্রেন বাঁশি বাজিয়ে অনেক দূরে কোথাও চলে গেল। ট্রেনের ভিতর ভিড়ে থেঁৎলে যাচ্ছে স্ত্রী  পুরুষ শিশু। এরা কি হিন্দু না মুসলমান ? কাকে ওরা টেনে হিঁচড়ে করিডরে নিয়ে যাবে? ধর্ম পরীক্ষা করবে? আমি কলম বাগিয়ে ধরে হেঁকে বললাম, বুড়ি একটু চা করে দিবি রে ? ঠক করে শব্দে চোখ তুলে দেখি বুড়ি নয় রাজিয়া চা এনেছে বিরক্ত মুখ, আমি বললাম, রাগ করিস নি রাজিয়া তোদের কথাই তো লিখছি। রাজিয়া বলল কাল আসবু নি কিন্তু আধার কার্ড আনতে যাব। কি আশ্চর্য রাজিয়ারও আধার কার্ড আছে আমার কেন নেই।

আমি বনগাঁ যাব বলে বেরিয়েছিলাম কি ভিড় কি ভিড়, ওপাশ থেকে আসছে রাজিয়া খুকু বুড়ি লীলা আনোয়ারা জান্নাতরা, এপাশ থেকে ট্রাক বোঝাই করে সারারাত গাভীর দল, বনগাঁর এই এক আশ্চর্য জাদুর হাট, চলমান হাট। আমি ভাবি বুড়ি কোথায় হারিয়ে গেল, সে কি এখন আর আগের মত ইশকুলে পড়ে না ? মস্ত শাদা ফ্রক পরে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গায় না, কাবেরি নদীজলে কে গো বালিকা? বালিকাটি কোথায় হারিয়ে গেল? রাজিয়া বাংলাদেশের অনুপ্রবেশকারিণী না, দক্ষিণ বঙ্গের মেয়ে, তাই কড়া, লোনা, ঝঙ্কার কণ্ঠি, অর্থাৎ ঝঙ্কার দিয়ে ছাড়া কথা কইতেই পারে না। তারই করুণায় আছি, খেয়ে পরে।

আধার কার্ডের গল্পটা লেখার মত কিন্তু। নাগরিক না নাগরিক নয় বোঝানোর জন্য দরকার। কিন্তু লাইনে দাঁড়িয়ে নিতে হলে বছর ঘুরে যাবে। তৎকাল আছে, কর্মচারী বা দালালদের করা একটু বেশি দিতে হবে তালেই তুমি নাগরিক হয়ে যাচ্ছ। কি সুন্দর স্বচ্ছ সহজ ব্যবস্থা রে নাড়ু।

দক্ষিণের ঘর থেকে বাইরে এসে দেখি উঠোনে আমার লাল পাড় দেয়া সবুজ গামছাটি ঝুলছে, পিছনে কলতলায় যাব, পেয়েছে, স্নানও পেয়েছে, স্নান শব্দটা শুনে আমার হঠাৎ পুকুরের জলের দৃশ্যটা মনে পরে গেল। বহুদিন পরে সেই পুরনো পুকুরের জলের স্পর্শ পেলাম, হাঁসগুলো এদিক ওদিক ভাসছে, ছড়ানো ছিটানো রোদের আলো, পড়ন্ত, অবেলা, আমি জলে নামতে চাই। আমার মৃগী রোগ আছে বলে আমার জলে নামা বারণ। ওরা আমায় পানিমুড়ার ভয় দেখায়। আমি জানি পানিমুড়া না, জলে আমার মৃত্যু বাস করে। কিন্তু আমি তার প্রেমে পড়েছি। ভিতরটা হাচড় পাঁচড় করতে থাকে, জানলার শিক ধরে বসে বসে দেখি, বালক রবির মত। কলঘরে অন্ধকারে উবু হয়ে বসে দেয়ালে নানা তন্তু জাল আকৃতি প্রকৃতি দেখি, অর্থ বুঝতে চাই, পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে আমার ভিতর থেকে সুতোটা বেরিয়ে আসছে, ওঃ কিছু একটা প্রসব করার কি কষ্ট কি আনন্দ তাই না?

গভীর রাতে পুকুরে আমি এক নগ্ন নারীমূর্তি দেখেছিলাম, চাঁদের আলো না কোন এক অন্ধকার অমাবস্যার মধ্যরাতে, একদম মা কালীর মত, অবশ্য করালবদনা নয়, আমার জানালার নিচে বটগাছের তলায় পুকুরের জলে সাঁতার কাটছে। কত অসংখ্য রাত আমি না ঘুমিয়ে কাটিয়েছি, পায়চারি করে বা জানালায় দাঁড়িয়ে থেকে, আমি তো  জ্ঞাতিদের এই বউটিকে জানি, আমি দক্ষিণের ঘর উঠোন পুকুরপাড়ে কতবার একে দেখে নিজে নিজেই লজ্জায় রাঙ্গিয়ে গেছি, সে হয়তো আমায় লক্ষ্যই করেই নি। সে আমার ব্যর্থ কামনা ছিল, পুকুরের জলে তার রূপ আমারই ব্যর্থ কামনার ছায়া আর কিছু নয়।

সে পাশের গ্রামের অংক মাস্টারের বউ ছিল, আমি সেই রাত থেকে প্রতি রাতে তাকে ডাকতাম পুকুরের জল অন্ধকারে শীতল সেখানে ঘাই মারত আমার ব্যর্থ কামনা। অন্ধকারে আমি তাকে ডাকতাম, এস এস এস ।

বুড়ির গল্পটা অন্যরকম। সে আমার ছোট বোন বা বোনের মতন কেউ, ১৯৪৭ না ৫০এর দাঙ্গায় তাকে তুলে নিয়ে যায়। সে আমায় বলত দাদা তোর গল্প না শুনলে আমার ঘুম আসে না। আবার ১৯৭১ এ সে ফিরে আসে। বনগাঁ সীমান্ত দিয়ে। আমি তাকে দেখি নি কিন্তু তার আলোকচিত্র দেখেছি আলিপুর জাতীয় গ্রন্থাগারের আর্কাইভে তার সঙ্গে কয়েকটি কিশোর শিশুও ছিল তারই সন্তান সন্ততি হবে। তখন তার নাম পালটে গেছে, বুড়ি বা মিতালি না সে হয়ে গেছে আমিনা। তার পেটে অনেকগুলি ফালা ফালা কাটা দাগ তার মুখে এত বছরের ব্যবধানেও বালিকার অপার বিস্ময়। সে কোনদিন সীমান্তে বিশ্বাসী ছিল না।

বুড়ির জন্মদাগ ছিল ঘাড়ের বেগনি তিল। আমি তার ছবি বহুভাবে উলটে পালটে দেখি কিন্তু তিলটি আছে কি নেই বুঝতে পারিনি। যদিও জানি তিলটি আছে। লুকনো তারার মত অসংখ্য মৃত আকাশের নিচে চাপা পড়ে আছে । হারায় নি । আমি ঋত্বিক ঘটকের যুক্তি তক্কো গল্পের কথা মনে করে অনেক কেঁদেছি, কেন চেয়ে আছ গো মা মুখপানে !

আমি কলতলা থেকে খালাস হয়ে বেরিয়ে আবার রাজিয়াকে চা করতে বলি রাজিয়া জবাব দেয় না কিন্তু যথাসময়ে চা অবশ্যই দেয়। আমি এখন আগের মত বুড়ো নেই আর, ধুঁকে ধুঁকে বাঁচার চাইতে মরা ভাল, ১৯৭১র দমদম বেহালা টালিগঞ্জ পেরিয়ে কোথাও গল্পটা ঘুরে যায়, সেই থেকে আমি একটা গুলিভরতি বন্দুকের স্বপ্ন দেখতে শুরু করি। দাঙ্গায় যখন মরি নি দুর্ভিক্ষেও না, লালবাজার লর্ড সিনহা রোডে দিনের পর দিন উলটো করে ঝুলিয়ে বেদম ধোলাইয়ের পরেও বেঁচে আছি, তখন এটাই স্বাভাবিক যে বুড়ি একদিন ঠিক ফিরে আসবে, তার সন্তানদের নিয়ে, আধার কার্ড সেরে রাজিয়া ফিরে আসবে, ভাত আর নিম বেগুন সঙ্গে আলুসেদ্ধ বানিয়ে রেখে যাবে খাটের তলায়, আমি পুকুরে তো শুধু জলকন্যাকেই দেখিনি একটা দেবীমূর্তিও ভাসান হতে দেখেছিলুম। সে কথা কাউকে বলা হয় নি কোনদিন। 

আমি এখন পূর্ণ যুবা, আমার খিদে পেয়েছে কিন্তু আমি ভাত খাব না। আমি লিখব, আবার, টুকরো টুকরো ভাঙ্গাচোরা গল্পগুলি সাজিয়ে গুছিয়ে তোমাদের একদিন শোনাব যদি তোমরা শুনতে চাও আপাতত হাতের মুঠোয় ১৯৭১র সেই পিস্তল চীনা পিস্তল যার নল নাকি ছিল আমাদের ক্ষমতা শক্তির উৎস। পাগলা কি ভুলই না করলি।

আমি অবাক হয়ে দেখি ভাঙ্গা দেয়ালে রোদের ছিটে আগুনের মত জ্বলছে। আমারই বন্দুকের গুলি লেগে রক্তের দাগ এখানে ওখানে। নাকি আমাদের নয় ? রঞ্জিত গুপ্তের পুলিশের ? থেঁৎলানো মানুষের শরীর পড়ে আছে ব্রিজের নিচে, তাদের ডিঙ্গিয়ে যাব কিভাবে ? এ এক আগুন নিয়ে খেলা যার শেষ সেদিন হবে যেদিন আবার আমরা আমাদের ভিটায় সেই দালানে সেই দক্ষিণের ঘরে সব্বাই একসঙ্গে ফিরে যেতে পারব। না স্মৃতি বেদনা না, ভবিষ্যতকে প্রসব করবে বুড়ি রাজিয়া মিলি হেনা প্রতিভা আশাপূর্ণা মাধুরী মহাশ্বেতা। হায় ভালবাসা


                                                                                                             (চিত্রঋণ : Desert of Forbidden Art Museum)

16 comments:

  1. অসাধারণ। কাহিনীটি বহুমাত্রিক। পড়ে ধাক্কা খেলাম।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ ঈশ্বরী, বহুমাত্রিকতার উল্লেখটি অত্যন্ত যথার্থ।

      Delete
  2. এক কথায় অনবদ্য।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ পাঠক বন্ধু।

      Delete
  3. আশ্চর্য রচনা। দেবাশিস ভট্টাচার্যর চির প্রবাস পড়েছি, ভীষণ ভাল লেগেছে। কিন্তু এ যেন সম্পূর্ণ অন্যরকম।

    ReplyDelete
    Replies
    1. চির প্রবাস different animal. ধন্যবাদ।

      Delete
  4. গল্পনাটি মন ভরে দিল, অপূর্ব লিখেছেন দেবাশিস ভট্টাচার্য।

    ReplyDelete
    Replies
    1. গল্প কবিতা গল্পনা যাই বল শেষমেষ তোমাদের ভাল লাগা অত্যন্ত জরুরি। ধন্যবাদ দামিনী।

      Delete
  5. গদ্যটি পড়ে ভালোই লাগল। কিন্তু গল্পনা বলতে 'বাক্‌' যে ধরনের গদ্যকে এতদিন বুঝিয়েছে তার সঙ্গে খাপ খায় না রচনাটি।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ পাঠক বন্ধু।

      Delete
  6. উত্তরাধুনিক হয়েছে কি না জানি না। কিন্তু রচনাটি নিঃসন্দেহে উচ্চশ্রেণীর হয়েছে। অর্ক চট্টোপাধ্যায় গল্পনা ভেবেছিলেন পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য। সুতরাং অভ্যেসকে ঝাঁকুনি দিয়ে সেটাই করা হয়েছে। আরেকটা কথা, শিল্প সাহিত্যে আসল জিনিশটি যা কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে, যাকে ব্যাখ্যা করা কঠিন, ধরা আরও কঠিন, বরং উপভোগ করাই শ্রেয়, যা অনেক সময় অপ্রত্যাশিত পাঠককেও প্রত্যাশার অতীত সুখ বা আনন্দ দেয় সেই মৌলিক সাহিত্য প্রসাদ গুণটি দ্রোহকালে রয়েছে অনেকদিন পর এরকম রোমাঞ্চকর গল্পনা পাঠ করে মুগ্ধ হলাম। সমাজ ও ব্যক্তি এখানে মিলে যাচ্ছে, নারীর অর্থ আবিষ্কৃত হচ্ছে কখনো দাঙ্গায় কখনো মুক্তিযুদ্ধে সীমান্ত পাচারে, শৈশবের ফ্রয়েড ফিরে আসছেন পুকুরে সাঁতার দেয়া নগ্ন নারী হয়ে, আর অনবদ্য সেই বর্ণনা যা লিখতে শুরু করে গল্পনার শুরু সেই বাড়িতে ফেরার আকাঙ্ক্ষা বেদনা স্বপ্ন আমায় বিমূঢ় করে দিয়ে গেল।

    ReplyDelete
    Replies
    1. সামান্য লজ্জা পাচ্ছি ঠিকই কিন্তু ভাল লাগছে দেখে যে আপনি রচনাটি এতখানি মনোযোগ দিয়ে পরেছেন ও প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন। অনেক ধন্যবাদ।

      Delete
  7. একদম ভিন্ন স্বাদের। আলাদা। মন বিবশ করে দেয়া। আফসোস করছি চিলেকোঠার জন্য লেখাটা না পেয়ে :-(

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ আখতার চিলেকোঠায় এইরকম আরেকটি হবে :)

      Delete