বাক্‌ ১১১ : মাসুদার রহমান




আইস এজ


১.
স্ট্যাচু দুটো বরফের

প্রথমে উওপ্ত পৃথিবী ঠাণ্ডা হয়ে এলো
তারপর বাষ্পীভূত জল এলো সমুদ্রে নদীতে

তারপর হিমযুগ

হিম লেগে জল জমে রূপ নিলো একজোড়া নারী আর পুরুষের বরফ স্ট্যাচ্যুতে

সূর্য বিকিরণও হচ্ছে সেই থেকে

বরফ শরীর গলে যোনি বেয়ে শিশ্ন বেয়ে
ফিরে যাচ্ছে সমুদ্রে আবার



২.
আন্তন চেখভের সহোদর ছিলাম

আমি আর চেখভ জন্মেছিলাম এক সাধারণ শীলমাছ শিকারীর ইগলুঘরে

বরফ ধ্বসে চেখভের মৃত্যু হলে পৃথিবী ভ্রাতৃশূন্য হল

ভ্রাতৃহীন একজন মানুষ দূরে বসে থাকি
ফুল না আসা এক বাদাম গাছের নিচে




৩.
এস্কিমোদের গ্রাম। চারপাশে দিগন্ত ছোঁয়া সাদা ফসলের মাঠ
এতো ভর-ভারন্ত ফসল ওরা ঘরে নিলে
এ বছর নির্ঘাত ধনী হয়ে যাবে

খুব লোভ হচ্ছে; এক এস্কিমো মেয়েকে বিয়ে করে আমিও থেকে যাব
এস্কিমো গ্রামে
আমারও জীবিকা হবে বরফের চাষ




৪.
সবুজ নর্তকীর পিছু নিয়ে এখানে এসেছি; অসহ্য তাপ ঢেলে দেওয়া
এই সূর্যের নীচে

মেয়েটির ঝকঝকে সাদা বরফ শরীর
গলে
মিলে গেছে সমুদ্র জলে

ওর শর্ট-স্কাট লাল ব্রা ও প্যান্টি
গোল করে পেঁচিয়ে
খেলছে সমুদ্রপারের গ্রামের একদল দরিদ্র বালক







৫.
ঘোড়াদের মৃত্যুচিন্তাগুলো স্যাতস্যাতে তার পাশে সুস্বাদু মাশরুম
গজিয়ে যায়
পাড়ার বেকার বায়স্কোপওয়ালা জিয়ারুল
মৃত্যু গন্ধমেশা মাশরুম তুলে এনে দুপুরের সবজিভোজ সারে
বরফ যেভাবে বড় নিশ্চুপ দূরে যায়
পৃথিবীর সমস্ত বায়স্কোপওয়ালারা ম্যাটিনির আলোয় ধীর মুছে যায়; ধীর




 .
এখানে আমার পাশে বসো
বরফ শীতল তবে দৃঢ়; এই ডাক

বয়সে সামান্য বড়; দিদি ডাকি
বুঝিনি প্রান্তরে রোদ ও আলোর পরে ছিল এক হরতকি গাছ

বুঝেছি যখন
তারপর থেকে; বরফ স্পর্শ করে টের পাই শীতল আগুন




.
সিলভিয়া প্লাথের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক বিবাহ পর্যন্ত এলো

আমি আর সিলভিয়া মিলে
মাছ-আড়তের পাশে বাড়িভাড়া নিয়ে আছি

শস্তায় মাছ কিনি; সহজ আমিষ খাই

আশপাশে অনেক বরফকলআমরা প্রস্তুত আছি
আমাদের সম্পর্কের
কখনও পচন এলে; শস্তা বরফ কিনে পচন ঠেকাব




.
টেড হিউজ ছেড়ে যাবার পর সিলভিয়া কাঁদছলো

সাতটি কুকুরেটানা স্লেজ গাড়ি খুবস তর্কতার সাথে
সামলিয়ে নিতে হয়
তা না হলে কুকুরেরা নিজের মধ্যে রক্তারক্তিকরে

পৃথিবীতে এ পর্যন্ত বেশিভাগ রক্তপাত ধর্মবিষয়ে হয়েছে; তুমি বিশ্বাস কর না?
চারপাশে অন্তহীন বরফের বিস্তার; এর নিচে রয়ে গেছে কয়লার বিশাল মজুদ

খনিশ্রমিকের তাবু; কাঁদছে শিশুটি

কান্না মূলতঃ অনেক গভীর থেকে উঠে আসা খনিজ বিষয়



.
সূর্যশাসিত দেশে বাল্যকাল কেটে গেছে
সেখানেওশীতকালছিল
মায়ের শাসন ছিল পরে নিতে শীতপ্রতিরোধক
এক উলের আস্তিন

এখন এখানে কানঢাকা মোটা টুপি; পা অবধি ঝুলের জ্যাকেট
আর গামবুট কার শাসনে এতো সহজে পরেছি?
উত্তরে ক্ষীণ আলো বরফের উপরে পরে; বরফ হাসছে





১০.
মেষপালকরা অহিংসার বিচিগুলো পুঁতে রেখে গেছে; ঠিকভাবে জলআলো
না পাওয়ায় গজিয়ে ওঠেনি

আমাদের উত্তরগ্রামে পশু চারণের কাজ এখনও জীবিকা

সূর্যকাল সরে আসে; সূর্যকাল সরে যায়
আপাতত ঘাস আলো উষ্ণতার খোঁজে তাঁবুর সংসার নিয়ে দক্ষিণে যাব




১১.
ভেরোনিকা হাসছিলহাসিগুলো পিছলিয়ে যাচ্ছিলো গ্লাসে
বরফের কুচি ঢেলেআমাকে বলছে, খাও
অল্প আলোর ঘর যাওয়া যায় হৃদপিণ্ডের ভেতর পর্যন্ত

বাইরে বাড়ছে রাত

বরফভোজের পরবরফের ভাষা দিয়ে লেখা হবে
নতুন কবিতা





১২.
বউদের বিচিত্র শখ; ওরা চায় ঘরের ভেতর
একুরিয়ামে
সমুদ্র পুষতে। কেউ পোষে টবে করে
একটি লঙ্কাগাছ
কেউ আবার কাঠের বাক্সে পোষে একজোড়া মুরগিও

বউদের শখ নিয়ে নানা মত আছে

বাউরা ফ্রিজের মধ্যে যত্নে লালন করে
বরফ ও নির্জনতা ভরা পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধ

সেখানেও শ্বেতভালুক! দেখেছেন কেউ?





১৩.
আইসক্রিম বিক্রেতা বাক্স ভরে নিয়ে যাচ্ছে
বরফের বাচ্চাগুলো

আহা রে! বাপ মা ছাড়া বরফের বাচ্চাগুলো

ওদের মা বাবা আছে পৃথিবীর উত্তরে; অনেক দূরের দেশে
ওরা আজ এখানে প্রবাসে!





১৪.
এক সাদা ভল্লুক সাদা প্রান্তরে হেঁটে যাচ্ছে
মনে হল
এই হেঁটে যাওয়ার মধ্যে খুব একাকীত্ব আছে

এই হেঁটে যাবার দৃশ্যে আরও এক দৃশ্য পাওয়া যায়

একজন কবি। মধ্যবযস্ক। কাঁধে ব্যাগ।শাহবাগ কিংবা কলেজস্ট্রিট থেকে
হেঁটে যাচ্ছেন নিঃসঙ্গতার বাড়ি





১৫.
আপেল চাষির গল্পে অনেক অংশ জুড়ে শীতকাল
বছরের কয়েকটি দিনমাত্র বরফের ঘটনা

আছে ওর গাছ হতে আপেল নামাবার
একটি সরলযন্ত্র, আপেল বহনের জন্য ঘোড়া দুটি

দিন শেষ হয়ে আসে

সন্ধ্যার কাছে ছোট আপেল বাগান রেখে
ঘরে যায় চাষি

ঘর এক প্রকাণ্ড আয়না

আয়নাটি সারারাত আপেল হয়ে উঠবার গল্প বলে



১৬.
জমে যাওয়া সমুদ্রের নিচে কোথাও রয়েছে কাঠের নৌকাটি

উত্তর থেকে দক্ষিণে
এক জাদুপুস্তক পৌঁছে দিতে গিয়ে নৌকাটি ডুবে গিয়েছিল

সে কথা জানে সাদা ভল্লুকেরা; ওরা বংশপরম্পরায় খুঁজেই চলেছে
বরফে লুকানো সেই জাদুর পৃথিবী



                                                                   (চিত্রঋণ : Maslenitsa, by Boris Kustodiev.)

21 comments:

  1. এক কথায় বলি। অসাধারণ ! কয়েকটি পড়লাম। পুরোটা ধিরে সুস্থে পড়ার জন্য প্রিন্ট নিলাম।

    ReplyDelete
  2. প্রিয় কবি,আপনি নিজেকে ছাড়িয়ে যাচ্ছেন দিনদিন এটাই আশ্চর্যের ও মনোমুগ্ধকর। এমন লেখা কয়জনে লিখতে পারে? ভাল লাগলো হে ভাবকল্পের নয়া যুবরাজ,শুভকামনা।

    ReplyDelete
  3. প্রিয় কবি,আপনি নিজেকে ছাড়িয়ে যাচ্ছেন দিনদিন এটাই আশ্চর্যের ও মনোমুগ্ধকর। এমন লেখা কয়জনে লিখতে পারে? ভাল লাগলো হে ভাবকল্পের নয়া যুবরাজ,শুভকামনা।

    ReplyDelete
  4. প্রিয় কবি,আপনি নিজেকে ছাড়িয়ে যাচ্ছেন দিনদিন এটাই আশ্চর্যের ও মনোমুগ্ধকর। এমন লেখা কয়জনে লিখতে পারে? ভাল লাগলো হে ভাবকল্পের নয়া যুবরাজ,শুভকামনা।

    ReplyDelete
  5. ১, ২, ৪ খুব ভাল। - রেনেসাঁ

    ReplyDelete
  6. "কান্না মূলতঃ অনেক গভীর থেকে উঠে আসা খনিজ বিষয়"
    এই পংক্তি আজকে পড়া সব লেখার শ্রেষ্ঠ লাইন। খুব ভালো লেগেছে মাসুদার দা।

    ReplyDelete
  7. খুব ভালো লাগলো... অনেকদিন পর কিছু ভালো লেখা পড়লাম।

    ReplyDelete
  8. ঠান্ডায় কব্জিতে অক্ষর জমে আছে। ...ভালো লাগলো এই সিরিজ

    ReplyDelete
  9. বরফ লুকোনো জাদুর পৃথিবীতে আমাদের মৃত আত্মাদের খুঁজে পাই। কবিতাগুলি এক ঘোরের অনবদ্য ক্রিয়ায়, নিজের ভাঙন ও বিবমিষায় গভীর পর্যটনে নিয়ে যায়।

    ReplyDelete
  10. Asadharan. Ek osadharan kalponar jogot gote tulechen kobi...anek anek avinondon.samridhho holam

    ReplyDelete
  11. মাসদুর দাদার কবিতা চিরকালই চিত্র প্রধান... তাই আমার প্রথম থেকেই ভালো লেগেছিল... এই গুচ্ছের কিছু কবিতা আমার আগে থেকেই প্রিয় যেমন আইস্ক্রিম কবিতাটি... আবার আইস এজের থেকে, যদি মিস্টার চমস্কি আবার আসেন, যদি গ্রামের উপরে হেলিকপ্টারের শব্দ পাই, তো দারুন ই হয় ...@ অভিষেক ঘোষ

    ReplyDelete
  12. আমার অন্যতম প্রিয় কবি মাসুদার। এক অদ্ভুত অনুভূতি হয়। কবিতা সরণি দয়ে যেন হেঁটে যেতে থাকি। একগুচ্ছ কবিতার পথ ধরে হাঁটলাম। ক্রমশ নিজেকেই ছাপিয়ে যাচ্ছেন কবি।

    ReplyDelete
  13. অজস্র প্রিয় পংক্তি প্রিয় কবি ...

    ReplyDelete
  14. এত মুগ্ধরকম কবিতা বহুদিন পড়ি নি। মাসুদ ভাই মূলত গোপনে লুকিয়ে থাকা আমাদের গভীরতম অহংকার।

    ReplyDelete
  15. বেশ ভালো লাগলো। অভিনন্দন।

    ReplyDelete
  16. বরফ গবেষণা বেশ নূতন রকমের

    ReplyDelete
  17. মাসুদার প্রিয় কবি অপূর্ব

    ReplyDelete
  18. সবকটিই দারুণ……

    ReplyDelete
  19. অসামান্য সব কবিতাগুচ্ছ! আগেই কিছু পড়া, এখন পড়লাম সবটা। কবি মাসুদার রহমান, কবি বিভাস রায়চৌধুরীর কবিতা পড়ে আমার গদ্য লিখতে ইচ্ছে করে খুব। একটা ঘোরের মধ্যে থাকি। এত প্রাণ!

    ReplyDelete
  20. পড়লাম । মাসুদার কবিতা আগ্রহ নিয়েই পড়ি ।

    ReplyDelete