বাক্‌ ১১১ : মাজহার সরকার




সব ঠিক হয়ে যাবে

গতরাতে খুব কাছে গিয়েও ছুঁতে পারিনি আমার সবটুকু সুখ পিছলিয়ে গেলো যতবারই ভালোবাসতে গেছি কেউ না কেউ কিছু না কিছু নষ্ট করে দিয়ে গেছে এতো কাছাকাছি এসে হাত বাড়ালেই নাগাল পাই বলে তৃষিত লোভে রক্তে মরি আরেকটু, হয়ে গেছে হয়ে গেছে এসে গেছি প্রায় এইতো পেয়ে গেছি খোঁজ! বসন্তের এই প্রান্তে আজ আমি সব কিছু পেতে যাচ্ছি কিন্তু না! প্রচণ্ড সুখের শীতে বেহায়া জিহ্বা যেন এক মাতাল যন্ত্রণায় বহে তবু মানুষ বলে- সব ঠিক হয়ে যাবে ঠিক হয়ে যাবে অনেক প্রশ্ন, শ্লোগান, সংঘর্ষ, যতো আশ্চর্য চিহ্ন সামনে অথচ সব কয়টার উত্তর আছে, আমার ঠোঁটের কাছেই ফিসফাস করে তবু দরজা খুলে না ধরতে গেলো ধরা যায় না। ভালোবেসে বেসে আমি ভালোবেসেছিলাম তার থুতু চেটে দেখি থুতুতে কাহিল জ্বালা একদিন তাকে আরও কাছে আমি চেয়েছিলাম সে চলে গেলো, চলে গেলো আর বলে গেলো- আম্মুকে ডেকে দিচ্ছিএতো কাছে এসেও আমাকে দুঃখ পেতে হবেপ্রেমিকার ফর্সা হাতের কাছে সান্ত্বনা নিয়ে বারবার ফিরে যেতে,যতোবারই ভালবাসতে গেছি কেবলই কষ্ট পেয়েছি   



এক বিষণ্ণ পথচারী

হাঁটতে হাঁটতে একদিন বুকের শান্তিটুকু পথে ঢেলে দেবো  ভোরের চুমুতে উজ্জ্বল মলয় জাগিয়ে নির্ভয়ে নুয়ে পড়বো, ক্ষীরের মতো নরম মাটিকে ভালোবেসে পুতে দেবো একটি বিদ্রূপের চারা পেছন থেকে চিৎকার আসবে, আর যেয়ো না যেয়ো না  আমি ফিরেও তাকাবো না হাঁটতে হাঁটতে কুকুরেরা ঘিরে ধরবে, ঘেউ ঘেউ করবে হাতের একমাত্র বনরুটিটা তাদের দিকে ছুঁড়ে দেবো গভীর রাতে অজস্র চুমু বিলিয়ে চলে যাবো পাতালের অনঙ্গ গহ্বরে যেখানে পাপ ছুঁয়েছে মাটির মায়া আর ফিরবো না, এই খণ্ডিত মানুষের জন্মান্ধ শরীরে স্বনামে দাঁড়াবো না আর আজন্ম সুহৃদের ভেতরে বাইরে কোথাও পাওয়া যাবে না, কোথাও অশ্রুর সরল ধারা আলোর অন্তরে এসে সত্য করে তরুণ ভ্রূণ  হাঁটবো, যেখানে পাথরের সন্তানেরা চাপা পড়ে আছে করোটিতে ধরে ঠোঁটের মাস্তুল জাগবে না প্রচ্ছদ প্রাণ, পৃথিবীর অগণন নির্মাণ স্রোতে ঢেকে যাবে সমুদ্র সড়ক হাঁটতে হাঁটতে তীব্র ক্ষুধায় থুথু ফেলে দেখবো, থুতুতে লেগে আছে এক বিষণ্ণ পথচারীর রক্ত




নদীর সমান হেঁটে গেলে

একটি তরুণ সাদা ঘোড়া আমাদের গ্রাম অতিক্রমের সময়
শরীর কাঁপিয়ে জ্বর এসেছিলো
টেবিলের ওপর দুধের গ্লাসটা নীল গাভী হয়ে
খেতে লাগলো আমার বুকের ঘাস
বাটি থেকে সেদ্ধ ডিমটা লাফিয়ে পড়ে তলপেটে
জলের রেখায় হাঁস হয়ে ভেসে গেলো পালক দুলিয়ে
টবের গাছগুলো ঊরুতে উড়ে এসেছিলো সবুজ আগুন নিয়ে
চুপিচুপি শো-কেসের হরিণ শাবক এসে স্মৃতি খেয়ে যায়
হৃদয় থেকে, আমি চেয়ে থাকি ছল করে দেখি না দেখে
নদীর সমান হেঁটে গেলে ওই তো আমাদের গ্রাম
পাতার মতো ঠোঁট কাঁপে জ্বরে আর সাদা ঘোড়া
তার চার পায়ের উৎকণ্ঠায় ফিরে আসে একাকী উদ্যানে
তারপর সকালবেলা জানালার পর্দাটা একটু সরতেই
কুয়াশার ভেতর থেকে মাধবী লতার সবুজ হাত এসে
বুকে বেদনার শিল্পীর ক্ষত নিয়ে আমার বিছানায় বসে পড়লো
সূর্যটা পিঠে উঠে এসেছিলো মৌলিক আগুন ছড়াতে ছড়াতে





মধুর ক্যান্টিন

গভীর রাতের মধুর ক্যান্টিন পাথরে খোদিত গানের মতো করুণ লাল দুইটা বাতি গাছের পাতা ফুঁড়ে জলজ শব্দের ডাক নিয়ে জেগে থাকে কেউ নেই, চায়ের কাপ চিনি চামচের টুংটাং নেই কানাই নেই কানাই! কানাই! দুই কাপ চা একটা চেয়ার বাইরে পড়ে ভিজে আছে অরুণ কি আজ  তাকে ভেতরে নিতে ভুলে গেছে! আহ চেয়ার, এখন আমাকে বসতে বলো নাসারাটা দিন এই সব চেয়ার ঝনঝন শব্দে এর ওর হাতে উঠোনেই ঘুরপাক খায় নর্তকির ক্লান্ত পায়ের মতো 

মধু দা’র ভাস্কর্যটা সাদা পাথরের ম্লান কোমলতা নিয়ে অঙ্গ ভরে ধরে মধ্যরাতের দীপ  দেয়ালের পোস্টারগুলো কাঙ্খিত আগন্তুকের খোঁজে দেয়ালের রঙ নিয়ে উঠে আসতে চাইছে গভীর রাতের মধুর ক্যান্টিন কোন আলো-অন্ধকার প্রকোষ্ঠের উজ্জ্বল শৈশবে পিতৃপিতামহের বিস্মৃত নামধাম জ্বেলে, মনে পড়ে? এখানে একা একা হৃদয়ে লুকিয়ে মুখ গাছের পাতা, উঠানে বিছানো ইট, অবিরাম বাজে শ্লোগানে আর শত ছাত্রের পায়ের আঘাতে আজ গভীর রাতে কেউ নেই এখানে উদাসীন শূন্যতার প্রপাতে, আমার বুক ভরে লেগে থাকে দাহ





সোনালি আপেল

আজ সন্ধ্যায় সাতটি রাজহাঁস আমার বুকের ভেতর ডুব দিয়ে পালিয়ে গেলো
সাতটি পাখার উষ্ণ অধ্যায়ে সবুজ পালক থেকে ঝরে পড়ে তৃষ্ণার জল
ত্বকের ভেতর ভূমিকম্প আর চোখের আয়ুতে উজ্জ্বল
আজ তোলপাড়, শিরা উপশিরায় লাল লোহিতের ঢেউ
কোন লোকে কোন চরে, কার আঙুলে নীল শব্দের চাবি বেজে উঠে?
আজ সন্ধ্যায় সাতটি রাজহাঁস আমার হৃদপিণ্ড ছিঁড়ে উড়ে গেলো
সাতটি নখের চুমুতে বুকের স্তব্ধ বাগান থেকে মিথুন ফল ছিঁড়ে নিয়ে
সেই শোভা আর তার মুখ প্রগাঢ় চুমুতে নির্মাণ করতে আজ এই
উৎসবে,সাতটি রাজহাঁস আমার বুকের রক্ত পান করে চলে গেলো
আজ সন্ধ্যায় পাঁজরের জানালায় তারা ডেকে ডেকে অভিষিক্ত হলো  
রাতের কাতরতা ছুঁয়ে আমি কি আর একবার তাকিয়ে দেখবো
বাসনারা অন্তিম দুঃখ নিয়ে কি করে দু’ঠোঁটে জমা রাখে চুমুর দাগ!
এই বিভক্ত পৃথিবীতে এই খণ্ডিত মানবিকী সময়ে এই রুগ্ন ইতিহাসে
আমাদের প্রেম কি সইবে ডানার আঘাত?
আহত আঙুল থেকে ঝরে পড়বে শোক!
আজ সন্ধ্যায় সাতটি রাজহাঁস কুরেকুরে খায় আমার বুকের মাংশ
সাতটি ডানায় উমের পালক ছড়িয়ে চারদিক ঘিরে মিলে ছিঁড়ে খায়
প্রার্থিত সোনালি আপেল


                                                                                           (চিত্রঋণ : Tyeb Mehta)

2 comments: