বাক্‌ ১১১ : কোলাজ কর্মশালা : অমিত বিশ্বাস



একটি বিকল্প রূপকল্পের সন্ধানে


রূপকল্প বেশির ভাগ সময় শুরু হয় শিল্পভাবনা থেকে। ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে এর নির্মান। প্রতিষ্ঠিত অথবা দীর্ঘদিন ধরে যিনি কাজ করছেন, সেই শিল্পীর  নিজস্ব একটি আঙ্গিক অর্থাৎ signature আমরা লক্ষ্য করে থাকি তাঁর রচনা কৌশলে। কিন্তু যদি এমন একটি  পরিকল্পনা করা হয় যেখানে শিল্পী পূর্বে ভেবে চিনতে শিল্পরচনায় বসবেন না, হাতের কাছে যে রসদ পাওয়া যাবে তা থেকেই শিল্পরচনায় উদ্যোগী হবেন ... তবে কেমন হয়?



এইরকমই কর্মসূচী নেওয়া হয়েছিল 'Vintage .com আমাদের দল' থেকে। উদ্দেশ্য শিল্পের বিভিন্ন সম্ভবনাগুলি ঝালিয়ে নেওয়া।  একদিনের একটি অভিনব 'কোলাজ কর্মশালা'র পরিকল্পনা করা হয়, মাষ্টার মহাশয় সুপরিচিত কোলাজ শিল্পী স্বপন দেনরা। আমরা জানি চিত্রপটে কোনো কিছুকে সাঁটাকে কোলাজ বলা হয়। উদ্ভাবক যতদূর জানি  জর্জ ব্রাক ও পাবলো পিকাসো যৌথভাবে। আধুনিক ভারতে বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় এর সম্ভাবনাকে এক অন্যমাত্রায় নিয়ে যান। পরবর্তীকালে কে.জি. সুব্রমনিয়ম, কে.সি.এস. পানেসর থেকে প্রণব ফৌজদার, শাকিলা, বিধান দেব হয়ে স্বপন দেনরা সবাই কোলাজকে সমৃদ্ধ করেছেন। স্বপনবাবুর কোলাজের অভিনবত্ব হল চিত্রকল্প প্রথমেই ভাবা হয় না। প্রথমে নানা ধরণের রঙিন পত্রিকা ঘাঁটা হয়, দেখতে হয় পরিচিত রূপকল্পগুলির মধ্যে বিকল্প কোনো রূপকল্প লুকিয়ে আছে নাকি ... যেমন ধরুন একটি জামার ভাঁজ এবং সঙ্গে জুড়ে থাকা হাতের দৃশ্যত অংশকে সামান্য ছেঁটে নিলে সেটি একটি অভিব্যক্তিমূলক মুখে রূপান্তরিত করা সম্ভব অথবা একটি কেতাদুরস্ত সাহেবি টুপি থেকে মৌচাকের রূপনির্মান। এরপর সেগুলিকে কাঁচি দিয়ে কেটে অথবা হাত দিয়ে ছিঁড়ে আঠা দিয়ে শক্ত সাদা বোর্ডের উপর সাঁটা হয়। কাঁচির ব্যবহার যে শিল্পরচনায় তুলির মতনই একটি অস্ত্র  এবং সেটি নিয়ে কোনোরূপ সংস্কারের মধ্যে আবদ্ধ নয় স্বপনবাবু।  আসুন এবার দেখে নি কর্মশালায় শিল্পীরা কীভাবে সৃষ্টি করলেন তাঁদের রূপকল্প নির্মাণ।



চিত্রপটে কোণাকুণি ভাবে একটি running shoe উপস্থিত। তার সাথে একটি কোটের টুকরো অংশ এবং কাপড়ের গোলাকার অংশ জোড়া হয়েছে। পা গলানোর জায়গাটি নিপুন ভাবে ছাঁটা। অনুভবে আসবে একটি নিরীহ মুখের আর্তনাদের অভিব্যক্তি। শিল্পী অশোক পৌলানের চিত্রপটের রঙ নির্বাচন বেশ শীতল, এখানেও তাঁর সেই সমুজ্জ্বল বৈশিষ্ট্য উপস্থিত। 



দেবী কালীর সাথে আমরা কালের দর্শনের মিল পাই। কালীর প্রথাগত রূপকল্পকে শিল্পী সন্দীপ সরকার pop art এর অনুষঙ্গে বিশ্লেষণ করেছেন। সময় থেমে যাওয়াকে দেখাতে কালীর কানদুটি ঘড়ি দ্বারা নির্মিত, রাক্ষসের নরমুন্ডের বদলে  সেলেব্রিটিদের মুন্ডু আবর্তিত হচ্ছে জনগণের রূপকল্প হিসাবে।



আধুনিক মানুষের নৈতিক মূল্যবোধ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে আগেও, শিল্পী মুক্তিরাম মাইতি সেই প্রশ্নে ইন্ধন যুগিয়েছেন তাঁর চিত্রকল্পে।  এই সুন্দর পৃথিবীতে মানুষ আজ তাঁর মানবিক স্বত্বা থেকে বিচ্যুত হয়ে বড়ই ব্যস্ত যান্ত্রিক উপভোগ্য যাবতীয় উপাদান নিয়ে। আমরা আমাদের নৈতিক বাঁধনকে বিসর্জন দিয়েছি, হয়ে উঠেছি অসামাজিক, হারাতে বসেছি আপন স্বত্বাকেই ... শিল্পী এই প্রশ্নগুলিকেই খুঁজেছেন।  ছাপা কাগজে ঠিক কি কি রূপকল্প জুড়ে জুড়ে তাঁর রূপকল্পটি গড়ে উঠেছে সেটি পাঠক নিজের মতন করেই খুঁজুন।



মানুষের বিপন্নতা শিল্পী চিন্ময় মুখোপাধ্যায়ের ছবির বিষয়...তাঁর অস্তিত্বের সংকট তাঁকে মানুষ শব্দর গণ্ডি ছাড়িয়ে দুপেয়ে পশুতে রূপান্তর করে। কোনো একদিন তাঁর যাবতীয় ইন্দ্রিয় দোষ দাঁড় করায় বিবেক নামক  আয়নার সামনে  .... তখন নিজের আসল রূপটি দেখে তাঁকে আঁত্‌কে উঠতেই হয়,আতঙ্কিত হতে হয়.... পপ আর্টের অনুষঙ্গে সেজে উঠেছে শিল্পীর রূপকল্পটি।



উত্তর কলিকাতার ভূমিপুত্র সুকল্যাণ ঘোষ কলিকাতার মানচিত্রকেই তাঁর রূপকল্পে কাছে লাগিয়েছেন ... গলা থেকে কোমর পর্যন্ত এর বিচরণ ক্ষেত্র। এর সাথে জুড়েছেন কলমের নিব, খনকযন্ত্রের (excavator) অংশবিশেষ  এবং যান্ত্রিক টুকরো।  মহানাগরিক সভ্যতায় মানুষ ধীরে ধীরে যন্ত্রমানবে অর্থাৎ চলতি ভাষার android-এ রূপান্তরিত হয়ে চলেছে... বাস্তবিক অভিজ্ঞতা এবং হাতের কাছে ছেঁড়া কাগজে পাওয়া টুকরো দিয়ে গড়ে তুলেছেন তাঁর শিল্পনির্যাস।



গৌরব রায়ের চিত্রকল্পে আমরা পাই,  নাগরিক জীবনের আড়ম্বর, ব্যস্ততা, দেখনদারি ... এই সব বাইরের ব্যাপার ক্রমাগত ব্যবহারের ফলে যখন মানুষ এসবকেই একান্ত সত্যি মনে করে আর তার আড়ালে ভুলে যায় তাঁর নিজের স্বরূপ, ভিতর আর বাইরের ভেদ হয়ে যায় নিতান্তই ভঙ্গুর অথবা ক্ষীণ। জ্যামিতিক কৌণিকতা ভরা নীল প্রেক্ষাপট এখানে বাহিরের প্রতিরূপ, জানালার পাশের গাছ বাইরে যাবার ইচ্ছার কথা জানান দেয় আর রংবাহারি পর্দা সেই ইচ্ছাকে আরো জোরদার করে তোলে।



লিজা সাহার ছবিতে আমরা পাই এক ফ্যান্টাসি সমৃদ্ধ নিসর্গ যেখানে ছেঁড়া কাগজের প্রজাপতিরা ডানা মেলে উঠে বেড়ায়। একটি কেতাদুরস্ত সাহেবি টুপি থেকে নির্মিত হয়  মৌচাকের রূপকল্প।



সব শেষে এই অর্বাচীন লেখকের একটি কোলাজ। চিত্রপটের ঠিক মাঝখানে একটি দুর্গম গিরি শিখর ... লক্ষ্য করলে দেখা যাবে এটি একটি মানুষের মুখ বিশেষ। একজন নির্ভীক পর্বতারোহী সেই শিখরটিকে অতিক্রম করার চেষ্টা করছেন। মুখটি মানব-মনের অবচেতন স্তরের রূপক, শিল্পী প্রতিনিয়ত সেটাকে অতিক্রম করার চেষ্টা করছে এটাই  ছবির মূল বক্তব্য। চিত্রপটের দুইপাশে ছেড়ে দেওয়া শূন্য স্থানগুলি উত্তর আধুনিক রচনা শৈলীর নিদর্শন। বাকিটা দর্শকের চিন্তাভাবনার উপর ছেড়ে দেওয়াই ভালো।

একমাত্র লীসা সাহা ছাড়া আলোচিত সকল শিল্পীরাই দীর্ঘদিন ধরে তাঁদের শিল্পসৃষ্টি করে যাচ্ছেন, এঁদের মধ্যে অনেকেই এইসময়ের শিল্পজগতে বেশ পরিচিত, প্রত্যেকেরই নিজস্ব রচনা শৈলী বিদ্যমান। স্বপন দেনরা, যাকে নিয়ে কবীর সুমন গান পর্যন্ত বেঁধেছেন ... দীর্ঘদিন কোলাজ নিয়ে গবেষণা করে চলেছেন, সমৃদ্ধ করছেন শিল্পজগতকে। তাঁর শিল্পরচনার মূল লক্ষ্য আমাদের পরিচিত রূপকল্পের মধ্যে থেকে বিকল্প রূপ সন্ধান করে তার দ্বারা শিল্প নির্মাণ। সেই দর্শনে অনুপ্রাণিত হয়ে এই কর্মশালায় উঠে এসেছে বিচিত্র সব রূপকল্প। আরো অনেকেই এই কর্মশালায় অংশগ্রহণ করেছিলেন কিন্তু প্রবন্ধের স্বার্থে নির্বাচিত কিছু সংখ্যক শিল্পীদের নিয়ে আলোচনা করা হল কেবল। আশা করা যায় নির্বাচিত এবংকর্মশালায় অংশগ্রহণকারী বাকি শিল্পীরা ভবিষ্যতে এই বিকল্প রূপসন্ধানের পথটিকে সমৃদ্ধ করবেন। 

1 comment:

  1. আগ্রহ নিয়ে পড়লাম। মূল্যবান, অমিত আপনার কোলাজ কৌতূহল উদ্রেক করে। শুভ কামনা বন্ধু ভাল, আরও ভাল সৃষ্টিশীল কাজের জন্য। প্রদর্শনী দেখার সুযোগ পেলে ভাল লাগবে।

    ReplyDelete