বাক্‌ ১১১ : সঞ্জীব নিয়োগী




যেকোনও শুরুর আগের জীবন


তুমি বারবার আমাকে ধর্তব্যের মধ্যে এনে ফেল কত মধু থেমে যায় তোমার...!

সুবর্ণা আকাশের দিকে মুখ তুলে চেয়েছিল। প্রশান্তর কথায়, সেকথার অনুরণনে, শব্দগুলোর মানে খুব গভীরভাবে বুঝতে বুঝতে এখন মানুষটার মুখের দিকে তাকিয়ে। কেনই বা সে আকাশের দিকে চোখ রেখেছিল, একটু আগে! তা কি বহুক্ষণের নিশ্চুপতার ফল? নিজের ক্ষুদ্রতা, মানুষের জীবনের অনন্ত রংবাহারের অনিশ্চিত অন্ধকার? যে অন্ধকার আসলে সময়ের সাথে ছবি হয়ে ফুটে ওঠে! ছবি তো নিজেই সুন্দর তার নিজস্ব সেমিট্রি আর ব্যঞ্জনায়। তোমার ভালো লাগা মন্দ লাগা সে বোঝে না।
কত দিন ভেবেছি জানো, প্রশান্ত আবার বলে, ভেবেছি আর আমিষ খাব না। তুমি যে আমাকে নিয়ে ভাব, একথা মনে আসে যখন, আর যখন অন্তরাত্মা দিয়ে শুধু গাছপালার উপর ডিপেন্ড করতে চাই খাবারের জন্য, তখন গভীর টানাটানি চলে মনের মধ্যে। সে কথা কী, এক দিনে, এইভাবে বলা যায়!  
সুবর্ণা আমার হাত তার হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে, থাক না। কিছু বলতে হবে না। কষ্ট হচ্ছে তোমার।
আমি ভাবি, সুবর্ণা একথা আমাকে বলে কেন। আমি কি প্রশান্ত! আরও ভয়াবহ বোকা বনে যাই। আমার কানে কি প্রশান্ত এসব গল্প একদিন বলেছিল? নাকি আজ ঠিক এই সময় সুবর্ণাই বলছে কিছু অতীত? অথবা এক্ষুনি চলছে এই ছবিক্রম!
‘তোমার জন্য আমি শেষ হয়ে গেছি। পুড়ে গেল আমার সারাটা জীবন’ এই কথা কবে বলেছে প্রশান্তকে, সুবর্ণা? যেকথার রেশ টেনে তবে কি আমি ভুল করে ওকে বলে ফেললাম ‘কত মধু থেমে যায় তোমার...!

মনের কথা বেশিক্ষণ মনে থাকেনা। ধরো, বাসে বা ট্রেনে বা অন্যভাবে যাচ্ছ, মনে বেশ একটা কথা এলো। ভাবলে, পরে আমাকে বলবে। পরে আর কিছুই মনে করতে পারলে না। শুধু শুধু বুকের ভেতরটা খচখচিয়ে মরলে; কী যেন...কী যেন... কী যেন...। নোটবুক রাখবে, পেন রাখবে। অনেক লেখক-কবিই রাখে। শব্দ বার বার আসেনা, কথা বার বার আসে না। ওই বিদ্যুৎ চমকানির মতো। ধরে রাখতে হয়।  
প্রশান্ত তাহলে কবি ছিল। যাক, আমার বিচলিত হবার কিছু নেই। সবটাই ওদের ব্যাপার। ওখানে আমার ঢুকে পড়ে বিচলিত হওয়া নেই।  বাড়তি আহ্লাদ যেটুকু, ধানাই-পানাই ছাড়াই সেটুকু উপভোগ্য। বা, ধরা যাক এলোমেলো কিছু ধারণা জন্ম নেয় যদি; আচ্ছা কামরসে কি কোনও ভাইরাস এমনও থাকে, যার থেকে আবার হাত পা বা অন্য কোনও অঙ্গ প্রত্যঙ্গের উপায় হয়। থেকে যায় সন্দেহমালা...  

।।দুই।।


তবে কীনা, মানুষের শরীর কিনা
আগেই শরীর এলো কোত্থেকে?
আগে পরে দিয়ে কী হবে? হয় আগে, নয় পরে
না, আবার একটা কথাও মনে হচ্ছে দেখ, যে, দুটোই তো একই সাথে -। তাই না?
এতো আরও ভালো সিদ্ধান্ত। আসলে, আসল কথা সেটাই।
পুরুষরা তো একটু মোটাদাগের হয়, নিজেরটা হলেই হলো; ওরা সঙ্গে কী আর রখবে বেচারিরা, বড়জোর – কন্ডোম!
এছাড়া কোনও কল্পনার উপায়ও যে নেই।
দরকারও নেই, অত উপায় ভাবার। আমি নেজেই সব ঠিক-ঠাক রাখি।  
কত উত্তর রাখা থেকে গেল আমার কাছে।
রেখে দিলে কেন সোনা। বের করলে না কেন।
তোমার দিক থেকে তো তেমন-একটা প্রশ্নই এলোনা।
চুমু খাইনি তোমায়? বলো?
এখনও সেভাবে খেলে কই। জানিনা কী আছে তোমার পাইপ-লাইন প্রোজেক্টে।
কীসের?
মানে, চুমু নিয়ে কী ভাবছ। নতুন যদি কিছু...
এত বড় শয়তানি করলি রে শয়তান, আমার সাথে। সব নিয়ে নিলি আমার।
কী নিলাম সোনা, কখন?  
কী খাওয়ালি এটা?
বিষ।
ভুলতে পারছি না কেন? মরে যাচ্ছি না কে? বিষ কি এমন হয়!
অমৃত।
তবে জ্বালা কেন মনে এত? শরীরে! পারছি না আমি আর।
কী?
বেঁচে থাকতে।
কে মাথার দিব্বি দিয়েছে?
মরে যেতেও পারছি না যে তোকে ছেড়ে। মরা-বাঁচার মধ্যে চলাফেরা করছি।
বিষামৃত।
জীবন্মৃত...
নাঃ। দুর! দারুণ বেঁচে আছি রে সোনা।
এক কাজ করো না। পুরোনো খবরকাগজ ফিরি করতে পার। সময়ও কটবে।
পুরোনো কেন। নতুনের হকারি খারাপ হবে নাকি! কীযে যা তা ...
না না। পার্কের গেটের সামনে পুরোনো নিয়ে দাঁড়াবে। নতুনের থেকে বেশি দামে-
অত সমাজসেবা পারছি না। কী এনেছিস আজ, দেখি। ব্যগ খোল। খুব খিদে রে।
আহা রে। চলো ক্যন্টিনে যাই। পেছনে রেল। স্টেশন থেকে, বা, খাওয়া বাদ দাও, একটা ট্রেনে উঠে চলো না ...। চলো না। চলো। গুডবাই করি চেনা আসবাব।
এত্ত বড় বড় বাক্য বলিস কেন তুই। আমার মাথায় ঢোকে না।
বেশ, খাবি চল। ইডলি। হেলদি। শরীর খারাপ হবে না। হেলথের পক্ষে।
হেলথ হেলথ হেলথ! তোমার ভাতে চুল পাও না কুসুম!

          ...এত সব খবর লেন-দেন হল সুবর্ণা আর প্রশান্তর ভেতর। ভাবছি আর হিংসেয় মরছি। ওরা কত কথা বলতে পারে। ওরা কত খবর নিতে পারে একে-অন্যের। ওরা কত কাছে পারে, দূরে পারে। আঙুলে আঙুল, টালবাহানা, সমর্পণ আর নিঃশর্ত; পারে। আর যত অভেদ্য বলয় আমার জন্য তুলে রাখে সযতনে। তুলে রাখে আর মাঝে মাঝে দেয়, নিষ্ঠুর হাসি হেসে। বলে, ভিক্ষে করে আদর খাবে তুমি?
          আরও বলে, যা ম্যাচ্যোর করল না স্বাভাবিক নিয়মে, গতিতে, তা ছুঁতে যাও কেন সোনা? আমি ভাবি, বলেফেলি, ঢং করে আবার সোনা ডাকার কী আছে! বলি না। নামটায় ব্যঙ্গ থাকলেও, চেনা চেনা  লাগে। অনেক অচেনা বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে গিয়ে হোঁচট খাই কিন্তু এই নামটা, যেকারণেই, যখনই, যেভাবেই বা যে-আবেগেই দিয়ে থাক, তেমন গায়ে লাগে না। রূঢ় মনে করা যেত, ডাকটা; কিন্তু সেদিকে আমি আর যাই না। নিঃস্ব না হবার ছলনায় ঘুরি-ফিরি।
          আর পরিচিত আসবাব আঁকড়ে থাকিবস্তু-সমুহ আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় নিজের কাছ থেকে দূরে। ভালো থাকা যায়, সেইভাবে থাকার কথা ভাবি। যেভাবে ভালো থাকা যায়। ভালো বলতে আমি কী কী বুঝি। সেভাবেই।   
  
।।তিন।।

জল-জল মায়া তোর উঠে আসে স্বপ্নতল থেকেবলতে পারত, সুবর্ণা, স্বপ্নের কথা বারবার কেন বল তুমি। কিন্তু বলে না, কারণ সে জানে, সেটা শুধু কথার কথা হয়ে ভেসে থাকবে বাতাসে আর আমি হাসব যখন সেই কথার অর্থহীনতায়, ওর ইগো হার্ট হবে। জানে না? বোকা নাকি। স্বপ্ন ছাড়া আর কোথায় এসেছ বল?
জেল থেকে ছাড়া পেয়ে আর বাড়ি ফিরে যাসনি কেন? সুবর্ণা বরং এই কথা জানতে চায়। মৃতপ্রায় নদীকিনারা থেকে খাবারের সন্ধান-শেষে কয়েকটা পাতিহাঁস মেথর পট্টির দিকে ফিরে যাচ্ছে তখন। মুখের সামনে ঝেঁপে নামছে অন্ধকার। ফুটে উঠেছে শহরের আলো। 
দশ বছর ছিলাম। দ-অ-শ ব-ছ-র। সেই আমি আর সেইআমিতে অনেক বদল দেখতে পাচ্ছিলাম। ধীরে ধীরে, ছাড়া পাবার আগের শেষ কয়েকটা বছরে। ভাবলাম, আমার আর সেখানে যেতে নেই। সেখানের জন্য আর আমি নেই।
বদলাতে চেয়েছিলি কতকিছু...
বদলেছে তো। হাইব্রিড আর কীটনাশকের দয়ায় কত অন্ন কোটি কোটি মুখে...
শুধু এটুকুই চেয়েছিলি?
মানুষের চাওয়া-পাওয়া সব বদলে যায় রে সু। ...আচ্ছা, প্রশান্ত কি জানে? প্রশান্ত কি জানে আমি বেঁচে আছি আজও? ...সুবর্ণা জানায়, আমি মরে গেছি। বহুকাল আগে। প্রশান্তর কাছে। প্রশান্তর কাছে যে-সুবর্ণা, প্রশান্ত জানে, সে-সুবর্ণার জ্ঞানে আমি মৃত। শরীর শরীর শরীর। অধিকারের শরীরটাই যার নেই, আমার, তাকে নিয়ে হয়ত সেই সমস্যা বোঝে না প্রশান্ত।
জানো, তবু ও সারাজীবন বুঝতে পারল না, আমার মধ্যে তার সমস্ত প্রামান্য পুরুষতা দিয়ে ঢুকে গেছে যখন, তখনও আমাকে আসলে সে পাচ্ছে নাবা, বুঝেছে। অত্তখানি সংবেদ কি আর নেই। শরীর-ঘোর কেটে গেলেই সেকি আর কখনও, মুহূর্তের জন্যও নিজের সাথে কোনও অদৃশ্য হিসেব নিয়ে বসেনি? তাই হয়? বার বার ঠকে যেতে যেতে কখনও তো থমকে ভেবেছে। জানো, আসলে বহুবারই প্রশ্ন এসেছে আমাদের, আমার আর প্রশান্তর মাঝখানে। আমার মুখের ওপর খুনির মতো ঝুঁকে-পড়ে জানতে চেয়েছে, কই কই কই? তুমি কোথায় সুবর্ণা? আর কতখানি ভেতরে গেলে তোমার সন্ধান পাব? ...নিষ্ঠুর হয়ে উঠতে চেয়েছে। কিন্তু শেষ-অব্দি পারেনি।
কেন, পারেনি কেন? নিষ্ঠুর হওয়া কি খুব কঠিন?
আমাকে ভালোবাসে তো।  
মায়া হয়না তোর? এমন কি করুণাও? আর দ্বিধা? ভালোবাসায় সাড়া না দেবার দ্বিধা?
সুবর্ণা অবিচল কাঠিন্য নিয়ে আমার চোখে চোখ রেখে বলে, শুধু রবীন্দ্রনাথ শোনাতে ইচ্ছে করে। ...তুমি মোর পাও নাই পাও নাই পরিচয়/ তুমি যারে জানো সে যে...
নদী কেমন ম্লান হয়ে আছে। আদপে বইছেই কিনা তাও বোঝা যায় না। যেদিন নদীপাড় নিঃঝুম আলো-আঁধারি মেখে চেয়ে দেখে আমূল বদলে যাওয়া শহরের দিকে, সেদিন এক পরিত্যক্ত ডিঙির খুব কাছাকাছি চলে এসে আমার ডান হাত তার বাঁ হাত দিয়ে পেঁচিয়ে  পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে ধরে, কাঁধে আলতো মাথা রেখে, বহু নিশ্চুপতার শেষে সুবর্ণা ফিস ফিস করে, ...পারি না যে। কী করব বল। আর কাউকে পারি না। তুই যে আসবি এত, এত্ত, এ----ত বছর পর, তাকি জানতাম। তবুও তো পারিনি। খুঁজেছি শুধু। কাকে জানি না। এখন বুঝি, আসলে তোকে।
আমি অপলক চেয়ে থাকি সু এর দিকে। এনামেই তো ডাকা। পুরোটা কখনো বলিনি তো। সু! সু! সু! ... এভাবেই তো। দেখছি, কত চুল পেকে গেছে সু এর। কত সুন্দর লাগছে তাকে। ধীরে ধীরে তার পাকা আর গ্রে চুলের মাথায়, কপালে হাত বুলিয়ে দিই। আজও আদরে ওর মাথা আমার কাঁধে নেমে আসে। সমস্ত ভার নামিয়ে দিতে চায় যেন। সমস্ত না–পাওয়া।
আমরা অতৃপ্ত আত্মা, সু?
হ্যাঁ...। না...। কী জানি!
না হলে ভূতের মতো এই অন্ধকারে হেজে যাওয়া নদীর নির্জনে ঘুরে বেড়াচ্ছি কেন, বল?
একথায় খিল খিল করে হেসে ওঠে সে। আমার বুকে ছোট্ট একটা কিল মেরে বলে,যাঃ!  
          আচ্ছা, প্রশান্ত কাঁদে না?
          বুঝতে দেয় না।
          রেগে যায় না?
          বুঝতে দেয় না।
          চলে যেতে চায় না? কেন পড়ে আছে? কী দিয়েছিস তুই?
          তুই কি ওর ওকালতি করছিস। প্লিজ, করবি না। প্রশান্তর জন্য যদি তোর খুব কষ্ট হয়, তাহলে বরং ...। শোন, তুই যে আসবি এভাবে আবার আমার জানা ছিলনাখুঁজে গেছি, ঠিকই। কিন্তু ভাবিনি, আবার ...। আমি ভালো আছি, থাকব। সমস্ত আসা-যাওয়া মেনে নিয়ে। না আসা , না যাওয়া মেনে নিয়ে। ওভাবেই সাজিয়ে নিয়েছি নিজেকে। প্লিজ রিকোয়েস্ট করিস না...
          করছি না তো। শুধু মনে হলো। প্রশ্ন একটা। আর কিছু না।
          শুতে বলিস না, প্রশান্তর সাথে, প্লিজ। ওটা পারব না। পারব না, পারব না! আর কোনও অবহেলা নেই তো।
          মন দিতে পারলি না, শরীর দিতে চাস না...আর কত অবহেলা বাকি থেকে গেছে?
মন পারিনি বলেই শরীর পারিনা, বুঝেছ আমার পুচকু সোনা?
এখনো এই নামে ডাকিস কেন রে। বুড়ো হয়ে গেলাম ... এদিকে দেখ ... দাড়ি-গোঁফ প্রায় সফেদ!
আমার তুমি যা যা , তা আমৃত্যু! বাইরের কালো-সাদা নিয়ে ভাবিস তুই? এরকম তো ছিলি না!
ফ্লাই ওভারের তলা দিয়ে ঝমঝমিয়ে ট্রেন। কথার শব্দ ভেসে যায় সেই স্রোতে। মুখ নিয়ে আসে কানের কাছে অগত্যা অথবা এই ট্রেনের শব্দের অপেক্ষায় ছিল আমার কান আর সুবর্ণার কথাময় ঠোঁট। কী কথা বলছ, শুনতে পাচ্ছি নাতো, ট্রেনটা চলে যাক না। কিন্তু সে শোনে না। কানের আরও আরও আরও কাছে চলে আসে; রক্তকণিকায়, মগজের তোলপাড়ে। পাবলিক প্লেসে শেষে চুমু খাবি নাকি গো পাগলি!
খেতে পারি। তুমি নিতে পারবে তো?
পারব না। অনেক চোখ মাঝখানে চলে আসে। অনেক প্রশ্ন গিজগিজ করে আকাশের গায়ে।
জানি তো। কেন তোর পাওয়া হল না আমাকে, এখন বুঝিস তবে? বুঝতে পারছিস?
কে তবে এটা? তুই না?
কিন্তু আমি যে এভাবে পেতে চাই নি। আমি যে... সব মধু তোর জন্য রেখে দিয়ে ছিলাম...
ট্রেন চলে গেছে। এখন দুজনের মাঝে শব্দের আপত্তি আর নেই। চুপ করে থাকাগুলো আবার কথা হয়ে ফুটে উঠতে পারছে ধীরে ধীরে। আমার হাত সুবর্ণা মুঠোয় নিয়েছে আবার। ওর মগজের চলমান ভাবনার ছবি নানাভাবে অনুভব করছি আমার ধরেথাকা হাতে। কত না কথা হাতে হাতে বিনিময় হয়। ছোঁওয়া দিয়ে বলে যাচ্ছে অনর্গল আবেগ। বুঝছে, সে, আমি বক্তব্য খুঁজছি। মানে খুঁজছি, ব্যাখ্যা খুঁজছি, সেমিট্রি খুজছি এখনো। শেষে কথা বলতে হয়।
হ্যাঁ রে, প্রশান্ত হাসে না?
হাসে তো!
জোরে না আস্তে? শোনা যায় না দেখা যায়, ওর হাসি?
যখন যেমন। হাসে। হাসে তো। কেন?
ওর বহু ইলাস্ট্রেশন দেখি আজকাল। সেই সব রঙে হাসি খুঁজে পাইনা...
তুই দেখিস, ওর কাজ?
বই কিনি যে। বা উপহার পাই। কভার তো আর ছিঁড়ে ফেলতে পারি না।
আমাকে বসিয়ে ন্যুডস্টাডি করেছে কতবার!
কত বার?
বহু বার। আগেও, এখনও...। শর্ত থাকে, তবে।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। ছুঁতে পাবে না। শুধু চোখে যেটুকু পাও। পারলে সেটুকুই নাও, নইলে আমি নেই। অন্য মডেলে যাও!    
ওর কাজ দেখি আর বিষণ্ণ হয়ে যাই...দু-একটা দেখেছি, ন্যুড। তোর চোখ নেই, সাদা।
হ্যাঁ, বলে আমি ওকে চিনতে পারিনি, আমি দৃষ্টিশক্তিহীন!
তুই একটু ট্রাই করিসনি কেন। কত কিছুই তো করিস জীবনে, বাধ্য হয়ে নিকোটিন-ধোঁয়া খাস না পথে-ঘাটে?
সব বাধ্যতা কি এক! এই কথা বললি তুই শেষে!
নিজেকে যে অপরাধী মনে হয় সু। আমার জন্য সে..., তার ছবির রং দেখে বুঝি...     
আচ্ছা, তুই যে প্রশান্তর হয়ে ওকালতি করিস মাঝে মাঝে, সেটা কি ভদ্রতা? মেকী ভালোমানুষপনা? কেন করিস? ...বলো? মুখের দিকে তাকিয়ে আছ কেন, ...বলো? উত্তর চাইছি আমি!
প্রশান্তর জন্য কষ্ট হয় আমার। আমি যদি প্রশান্ত হতাম! প্রশান্ত যদি হতো আমি!
হয়নি তো। হতে পারেনি তো। পারেনি...তুমি যা বল, তা পুরুষের ইগো থেকে। অন্য পুরুষের জন্য, প্রশান্তর জন্য, তোমার, মায়ার দ্বন্দ্ব আসলে উদারতার চেয়েও ঢের বেশি ইগোর কারণে। বুঝলে মহাপুরুষ!  

।।চার।।

তাহলে কি আমাকে আবার প্রথম থেকে শুরু করতে হয়...? যেখানে আর ধর্তব্যের মধ্যে গিয়ে পড়ব না তোমার! কত মধু উঠে আসে কীভাবে জানি নাথেমে যাবে না সেগুলো তাহলে।
জানো, কত শান্তি পায় প্রশান্ত এই কথা ভেবে, যে, তুমি আর পৃথিবীতে নেই। তার জন্য মায়া হয় তোমার? তার জন্য? আমাকে নরম হতে বল?
তুমি কি জানতে আমি বেঁচে আছি! নিজে জানতে তুমি, বলো?
জানতাম না সোনা। আমি সত্যি জানতাম না। তবে প্রবল ভাবে মানতাম। বিশ্বাস করতাম। কিন্তু প্রশান্ত অবিশ্বাসী। তোমার মৃত্যু সে মেনে নিয়েছিল। কেননা সে চেয়েছিল। তার ভালোলাগার বিষয় ছিল সেটা। সেই চাওয়াটাকে মেনে নিতে পারিনি, তাই ওকেও পারিনি।  
চল, ওকে মাফ করে দিই। ও তো সময়ের দাস।
না। কক্ষনো না। ও অবিশ্বাসী। ও তার ছবির রং বাতাসের গন্ধ শুঁকে বদলে ফেলে!
কিন্তু ও তো -
শোন, মাথা ঠাণ্ডা রেখে শোন। ...যেদিন তোর হিংসে হবে প্রশান্তর কথা ভেবে, সেদিন ঠিক বুঝতে পারব আমি। সেদিন থেকে আবার শুরু হবে তোমার আর আমার নতুন ইতিকথা। তার আগে আমি মাথা রাখছি বটে তোর কাঁধে, কিন্তু তুলে নিতে পারি যে-কোনও সময়জানি, এই মন নিয়ে আমাকে পুরোটা নিতে পারবি না তুই। যেদিন দাউ দাউ জ্বলবি, প্রশান্ত আমাকে ছুঁয়েছে ভেবে শ্বাসকষ্ট হবে তোর, সেই দিন আবার হবে পরবর্তী দেখা, দ্বিধাহীন, অক্লান্ত, কোনও পিছুটান আর থাকবে না আমার জানব, শুধু বেঁচে আছি গোটা একটা আমি আর গোটা একটা তুই, বাদবাকি দৃশ্য সব তুচ্ছ হয়ে গেছে। যেন তোকে ছোঁওয়ামাত্র পুড়ে যাই আমি, সেই দিন


                                                          (চিত্রঋণ : Józef Chełmoński )      

5 comments:

  1. ইসস। কী লিখেছেন! যত পৃষ্ঠার নীচের দিকে নামছি.... তত নির্বাক হচ্ছি। নিজেও আলতো হাসছি। দারুণ দারুণ দারুণ।- রেনেসাঁ

    ReplyDelete
  2. আহা, দুর্দান্ত। আশ্চর্য সুন্দর। একদম এরকমই আরো -

    ReplyDelete
  3. হ্যাঁ ভালোই লাগল বেশ... @ অভিষেক ঘোষ

    ReplyDelete
  4. অনবদ্য ... ঠিক এইরকমটি আমি লিখতে চাই গল্প ... পারি না ... তবু ঈর্ষা করি না ... বন্ধু হে ... দূর থেকে পড়ি , মুগ্ধ হই ...

    ReplyDelete
  5. কতটা প্রোজেয়িক হলে এমন পোয়েটিক হওয়া যায়!

    ReplyDelete